কেউ কেউ মিসেস দাসকে জিজ্ঞাসা করে, যাত্রীর নাম কী?
মিসেস দাস জবাব দেন, তিনি নাম আমাকে বলেছিলেন কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছি। কিন্তু কথাটা সত্য নয়। নিজের মুখ ও যাত্রীর সুনাম রক্ষা করবার জন্যেই মিসেস দাস ওরকম বাজে কথা বলতে বাধ্য হন। যাত্রীর ব্যবহার খুব ভদ্র ও গলার আওয়াজ খুব মিষ্ট না হলেও স্বাস্থ্যনিবাসের বিলের টাকা কোনওদিনই সে বাকি রাখেনি এবং মিসেস দাসকে মাঝেমাঝে জরিমানার টাকা দিতেও কোনওদিন সে আপত্তি করেনি। মিসেস দাসের মতে এমন প্রথম শ্রেণির অতিথি জীবনে একবার মাত্রই পাওয়া যায়।
মিস্টার দাস একথা মানতেন না। যাত্রীকে তার মনে ধরেনি। রতনবাবুর মতন তিনিও যাত্রীকে মনে মনে সন্দেহ করতেন।
কিন্তু মিসেস দাসের সামনে এ সন্দেহ প্রকাশ করলেই ব্যাপারটা গুরুতর হয়ে উঠত। তিনি ঘন ঘন হাত-মুখ নেড়ে বলতেন, আহা, কোনও দৈব-দুর্ঘটনায় বেচারির মুখে চোট লেগেছে তাই সে ব্যান্ডেজ বেঁধে থাকে! স্বাস্থ্যনিবাসে সে সারতে এসেছে। চোর-ডাকাত হলে সে কখনও বিলের টাকা এমন করে শোধ করত?
শান্তিভঙ্গের ভয়ে মিস্টার দাস আর কিছুই বলতেন না।
শ্রীপুরে এক সরকারি ডাক্তার ছিলেন, তাঁর নাম মানিকবাবু। নানান লোকের মুখে নানান কথা শুনে একটা বাজে ওজর নিয়ে মানিকবাবু একদিন যাত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এলেন।
মানিকবাবু ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখলেন, ইজিচেয়ারের উপরে একখানা বই নিয়ে ব্যান্ডেজ করা মুখে এক ব্যক্তি শুয়ে আছে।
তাঁকে দেখেই লোকটা উঠে বসে গম্ভীর স্বরে বললে, এখানে আপনার কি দরকার?
মানিকবাবু বললেন, মশাই, আমি সরকারি হাসপাতালের জন্যে চাঁদা আদায় করতে এসেছি।
যাত্রী ফ্যাঁচ করে হেঁচে ফেলে বললে, বটে!
মানিকবাবু শুধোলেন, কিছু দেবেন কি?
যাত্রী আবার হেঁচে বললে, সে কথা পরে ভাবা যাবে। তারপর আবার হাঁচলে।
মানিকবাবু বললেন, অত হাঁচছেন কেন? সর্দি হয়েছে নাকি?
যাত্রী বললে, হ্যাঁ।
মানিকবাবু বললেন, আমি ডাক্তার। সর্দির একটা ওষুধ লিখে দেব?
যাত্রী আবার নিজের কেতাবের দিকে তাকিয়ে বললে, সেটা আপনার ইচ্ছে!
মানিকবাবু নিজের পকেট থেকে একটু টুকরো কাগজ আর পেনসিল বার করে কি একটা ওষুধের নাম লিখলেন। তারপর সেই কাগজের টুকরোটা যাত্রীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই নিন।
আলোয়ানের ভিতর থেকে জামার একটা হাত বেরুল! কেবল জামার হাতা–মানুষের হাতের কোনওই চিহ্ন নেই! অথচ সেই হস্তহীন জামার হাতা ঠিক স্বাভাবিক ভাবেই এগিয়ে এসে মানিকবাবুর হাত থেকে কাগজের টুকরোটা গ্রহণ করলে! ভয়ঙ্কর বিস্ময়ে তার দুই চক্ষু ছানাবড়ার মতন হয়ে উঠল। এবং মানিকবাবুর মুখ-চোখের ভাব দেখেই যাত্রী জামার হাতটা সাঁৎ করে আবার আলোয়ানের ভিতরে ঢুকিয়ে ফেললে।
সেই কনকনে শীতেও মানিকবাবুর কপালে ঘামের ফোঁটা ফুটে উঠল। অস্ফুট স্বরে তিনি বললেন, আপনার কি হাত কাটা গেছে? কিন্তু কাটা হাতে আপনি আমার হাত থেকে কাগজের টুকরোটা নিলেন কেমন করে?
তাই নাকি? বলেই যাত্রী সিধে হয়ে উঠে দাঁড়াল।
মানিকবাবু দু-পা পিছিয়ে এসে বললেন, হ্যাঁ। আপনার হাত নেই, খালি জামার হাতা আছে!
যাত্রী দু-পা এগিয়ে এসে ব্যঙ্গের স্বরে বললে, আমার হাত নেই খালি জামার হাতা আছে! বটে? আলোয়ানের ভিতর থেকে আবার হস্তহীন জামার হাতা বেরুল হাতাটা একেবারে মানিকবাবুর মুখের সামনে এসে হাজির হল–তারপর কে যেন দুটো অদৃশ্য আঙুল দিয়ে তার নাকটা খুব জোরে মলে দিলে!
এর পরেও কোনও ভদ্রলোকেরই সে-ঘরে থাকা উচিত নয়। মানিকবাবু তিন লাফে দরজা পেরিয়ে ঘরের বাইরে গিয়ে পড়লেন। তারপর দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনলেন, ঘরের ভিতর থেকে যাত্রী অট্টহাস্য করে উঠল।
স্বাস্থ্যনিবাসের বৈঠকখানার বসে মিস্টার দাস তখন মিসেস দাসের সঙ্গে তর্ক করছিলেন। হঠাৎ মড়ার মতন সাদা মুখ নিয়ে মানিকবাবুকে সেখানে আসতে দেখে তিনি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কি হয়েছে মানিকবাবু, অত ছুটে আসছেন কেন? ডগি তাড়া করেছে বুঝি?
মানিকবাবু ছুটে গিয়ে একখানা চেয়ারের উপরে ধপাস করে বসে পড়ে বিষম হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, মিস্টার দাস! ওঃ, হাত নেই খালি জামার হাতা!
মিস্টার দাস সবিস্ময়ে বললেন, কি বলছেন ডাক্তারবাবু? হাত নেই জামার হাতা?
মানিকবাবু বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ! হাত নেই–জামার হাতা! ওপরের ঘরের সেই ভূতুড়ে লোকটার হাত নেই খালি জামার হাতা আছে। জামার হাতা দিয়ে সে আমার নাক মলে দিলে! বলেই তিনি দুই চোখ কপালে তুলে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
.
পঞ্চম । ডাক্তারের বাড়িতে চুরি
সরকারি হাসপাতালের এক অংশে সরকারি ডাক্তার মানিকবাবু স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বাস করতেন।
হস্তহীন জামার হাতা দেখে মানিকবাবুর, শরীরটা আজ বেজায় কাহিল হয়ে পড়েছিল। মিস্টার ও মিসেস দাস ও নিজের স্ত্রী বিমলার কাছে বারবার তিনি এই গল্প বলেছেন কিন্তু তাঁর কথায় ওঁরা কেউই বিশ্বাস করতে রাজি হননি। তাঁদের সকলেরই মত হচ্ছে, জামার হাতাটা হয়তো বেশি লম্বা ছিল বলেই হাতখানা তিনি দেখতে পাননি। শেষটা মানিকবাবু নিজেও মনে করলেন, হয়তো সেই কথাই ঠিক হবে, তারই চোখের ভুল!
অনেক রাতে মানিকবাবুর ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই তিনি শুনলেন তাঁর স্ত্রীর বিমলা তাঁকে ধাক্কা মারতে মারতে বলছেন, ওগো ওঠো! শিগগির ওঠো!