পরমুহূর্তেই দুর থেকে অন্ধকারের মধ্যে জেগে উঠল রেল-ইঞ্জিনের বাঁশির মতন তীক্ষ্ণ একটা শব্দ।
মৃণু সভয়ে বললে, সর্বনাশ, ওদের প্রহরীর ঘুম ভেঙে গেছে!
এখন উপায়?
আর কোনও উপায় নেই। ওই শুনুন, ওদের পায়ের শব্দ। ওরা এদিকেই ছুটে আসছে!
.
তেরো । রাত্রির কোলে সন্ধ্যানদী
আসন্ন মরণের সম্ভাবনায় যারা ছিল এতক্ষণ জড়ভরতের মতন, জীবনের নতুন আশা তাদের সমস্ত নিশ্চেষ্টতাকে একেবারে দূর করে দিলে।
লতা-দিয়ে তৈরি মাত্র একগাছা দড়ি,–কোনওরকমে একজন মানুষের ভার সইতে পারে, তাই ধরে একসঙ্গে উপরে উঠতে গেল অনেকগুলো লোক। তাদের সকলের টানাটানিতে সেই দড়িগাছা গেল হঠাৎ পটাস করে ছিঁড়ে। শূন্যে যারা ঝুলেছিল, নীচেকার লোকদের ঘাড়ের এবং গর্তের পাথুরে মেঝের উপরে তারা হুড়মুড় করে এসে পড়ল এবং আতঙ্ক ও যন্ত্রণা মাখা এক বিষম আর্তনাদে চারিদিক পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
সে আর্তনাদ গর্তের উপরে এসেও পৌঁছোল, কিন্তু সেখানে তখন তা শোনবার অবসর ছিল না কারুরই! দলে দলে দানব ছুটে আসছে, তাদের পায়ের ভারে মাটি কাঁপছে, সকলের কান ছিল কেবল সেই দিকেই।
বিমল জিজ্ঞাসা করলে, মৃণু, মৃণু! কোনদিক দিয়ে গেলে আলোক-ঝরনা পেরিয়ে নদীর ধারে যাওয়া যায়?
মৃণু বললে, ওইদিকে!
বিমল বললে, সবাই তবে ওইদিকেই ছোট–আর কোনও–
কিন্তু বিমলের কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা অতিকায় ছায়ামূর্তি কোথা থেকে তার উপরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মৃণুর মশালের আলোতে কুমার সভয়ে দেখলে, সেই ছায়ামূর্তির বিরাট দেহের তলায় পড়ে বিমল যেন একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেল!
কিন্তু পরমুহূর্তেই একটা বন্দুকের শব্দ গিরি-গহ্বরের সেই বদ্ধ আবহাওয়ায় বহুগুণ ভীষণ হয়ে বেজে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই ছায়ামূর্তিটা সশব্দে মাটির উপরে আছাড় খেয়ে পড়ল।
তার পরেই বিমলের গলা শোনা গেল,-একেবারে বুকে গুলি লেগেছে, এ যাত্রা আর ওকে মানুষ চুরি করতে হবে না! ছোট ছোট, নদীর ধারে–নদীর ধারে!
সবাই তিরের মতো ছুটতে লাগল! ওই আলো-ঝরনা দেখা যাচ্ছে, চারিদিকের অন্ধকার পরিষ্কার হয়ে আসছে এবং আলোকের সঙ্গে সঙ্গে আসছে মুক্তির আভাস!
কিন্তু পিছন থেকে অমানুষিক কণ্ঠের তীক্ষ্ণ হুঙ্কার এবং অসংখ্য পায়ের শব্দ ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে।
বিমল দাঁড়িয়ে পড়ে বললে, কুমার! বিনয়বাবু! ওরা একেবারে কাছে এসে পড়লে আমরা আর কিছুই করতে পারব না। এইবারে আমাদের বন্দুক ছুঁড়তে হবে। এখানে আলো আছে, আমরা লক্ষ্য স্থির করতে পারব।
একসঙ্গে তিনটে বন্দুক গর্জন ও অগ্নি-উদগার করতে লাগল! বন্দুকের গুলি যখন ফুরিয়ে আসে, তখন তিন-তিনটে রিভলভারের ধমক শুরু হয় এবং ইতিমধ্যে রামহরি আবার বন্দুকগুলোতে নতুন কার্তুজ পুরে দেয় এবং বন্দুক আবার মৃত্যুবৃষ্টি করতে থাকে। এবং রামহরি দু-হাত শূন্যে তুলে নাচতে নাচতে চেঁচিয়ে ওঠে–বোম বোম মহাদেব! বোম বোম মহাদেব!
আর বাঘা খুশি হয়ে ল্যাজ নেড়ে তালে তালে বলে–ঘেউ ঘেউ ঘেউ, ঘেউ ঘেউ ঘেউ, ঘেউ ঘেউ ঘেউ!
চারটে দানবের লীলাখেলা একেবারে সাঙ্গ হয়ে গেল, আট-দশটা প্রপাত ধরণীতলে হয়ে ছটছট করতে লাগল। তাই দেখে আর সবাই ভয়ে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে আবার অন্ধকারের ভিতরে পিছিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল!
বিমল বললে, মৃণু! এইবারে ছুটে নদীর ধারে চল!
আবার সবাই ছুটতে আরম্ভ করলে। আলো-ঝরনা পার হয়ে আরও খানিকদূর এগিয়েই শোনা গেল, গম্ভীর এক জল-কল্লোল!
তারপর আলো-ঝরনা ছাড়িয়ে সকলে যতই অগ্রসর হয়, চারিদিকের অন্ধকার আবার ততই ঘন হয়ে ওঠে।
বিমল শুধোলে, মৃণু, আমরা কি আবার অন্ধকারের ভিতর গিয়ে পড়ব?
মৃণু বললে, না। এই দেখুন, আমরা নদীর ধারে এসে পড়েছি! এখানে বেশি আলোও নেই, বেশি অন্ধকার নেই,–এ যেন মায়া-রাজ্য! মায়া-রাজ্য না হোক, ছায়া-রাজ্য বটে! এখানে কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না সমস্তই যেন রহস্যময়! এই আলো-আঁধারির মাঝখান দিয়ে যে বিপুল জলস্রোত কোলাহল করতে করতে দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে, তার পরপার যেন রাত্রির নিবিড় তিমিরের ভিতরে হারিয়ে গিয়েছে। এ নদী দেখা যায়, কিন্তু স্পষ্ট করে দেখা যায় না। মনে হয়, ওর গর্ভে লুকিয়ে আছে কত অজানা আর অচেনা বিভীষিকা! ওর জলধারা যেন নেমে যাচ্ছে পাতালের বুকের তলায়!
বিমল বললে, আমি যদি কবি হতুম তাহলে এ নদীর নাম রাখতুম, সন্ধ্যানদী। কবিতার ভাষায় বলতুম, অন্ধ রাত্রির পদতল ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যানদীর অশ্রুধারা!
রামহরি বললে, খোকাবাবু, তুমি জানো না, এ হচ্ছে বৈতরণী নদী, এ নদী গিয়ে পৌঁছেছে যমালয়ে, এর মধ্যে নামলে কেউ বাঁচে না।
বিনয়বাবু বললেন, বিমল, এর ভেতরে নামা কি উচিত? পাহাড়ের গহ্বরে অনেক নদী আছে, পাহাড় থেকে বাইরে বেরিয়েছে যারা প্রপাত হয়ে। এ নদীও যদি সেইরকম হয়? তাহলে তো আমরা কেউ বাঁচতে পারব না!
বিমল জবাব দেওয়ার আগেই তাদের চারিদিক থেকে আচম্বিতে বড় বড় পাথর বৃষ্টি হতে লাগল। বিমল তাড়াতাড়ি বলে উঠল–লাফিয়ে পড়ো–জলে লাফিয়ে পড়ো, আর কিছু ভাববার সময় নেই–দানবরা আবার আক্রমণ করতে এসেছে।
সবাই একসঙ্গে নদীর ভিতর লাফিয়ে পড়ল। তখন জলের ভিতরেই পাথর পড়তে লাগল। সে সব পাথর এত বড় যে তার একখানা গায়ে লাগলে আর রক্ষা নেই! সকলে তাড়াতাড়ি সাঁতার কেটে ডাঙা থেকে অনেক তফাতে গিয়ে পড়ল, শত্রুদের পাথর আর ততদূর গিয়ে পৌঁছোতে পারলে না!