দুঃখের হাসি হেসে বিনয়বাবু বললেন, কিন্তু দড়ি বেয়ে উপরে উঠলেও তো আমরা এই অন্ধকূপের গর্ভ থেকে বেরুতে পারব না। অন্ধের মতন এর ভেতরে এসে ঢুকেছি, কিন্তু বেরুবার পথ খুঁজে পাব কেমন করে?
কুমার খানিকক্ষণ ভেবে বললে, ভালোয় ভালোয় যদি বেরুতে না পারি, আমরা ওই দানবদের সঙ্গে যুদ্ধ করব।
বিনয়বাবু বললেন, তাতে কোনওই লাভ হবে না। যুদ্ধে হেরে মরব আমরাই।
কুমার বললে, তাদের ভয় দেখিয়ে জিতে যেতেও পারি। আমাদের কাছে তিনটে বন্দুক আর তিনটে রিভলভার আছে। তাদের শক্তি বড় অল্প নয়।
রামহরি বললে, তোমরা একটা বন্দুক আমাকে দিও তো। অন্তত একটা ভূতকে বধ করে তবে আমি মরব।
বিনয়বাবু বললেন, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়! হ্যাঁ, ভালো কথা! এই গর্তে আরও অনেক মানুষ রয়েছে। এদের কি উপায় হবে!
কুমার বললে, কেন, ওরাও আমাদের সঙ্গে যাবে। ওদের সঙ্গে নিলে আমাদের লোকবলও বাড়বে।
বিনয়বাবু বললেন, ছাই বাড়বে! দেখছ না, ভয়ে এরা একেবারে নির্জীব হয়ে পড়েছে। কাপুরুষ কোনও কাজেই লাগে না।
কুমার বললে, বিমল, তুমি যে বড় কথা কইছ না?
বিমল বললে, আমি ভাবছি।
কী ভাবছ?
মৃণু চিঠিতে লিখেছে–আলো-ঝরনার ওপাশে আছে মস্ত এক নদী–আমি সেই নদীর কথাই ভাবছি।
এখন কি নদী-টদি নিয়ে মাথা ঘামানো উচিত? আগে নিজের মাথা কী করে বাঁচবে সেই কথাই ভাবো।
কুমার, আমি মাথা বাঁচাবার কথাই ভাবছি। তোমার বন্দুক- টন্দুক বিশেষ কাজে লাগবে না, ওই নদীই আমাদের মাথা বাঁচাবে!
কুমার আশ্চর্য হয়ে বললে, কীরকম?
বিমল বললে, আমরা পাহাড়ের ওপরে আছি। এখানে যদি কোনও মস্ত নদী থাকে, তবে তা নিশ্চয়ই পাহাড়ের গা বেয়ে নীচের দিকে নেমে, এই অন্ধকূপের ভিতর থেকে বেরিয়ে গেছে। কেমন, তাই নয় কি?
হুঁ। তারপর?
মৃণু লিখেছে–এদেশের কেউ সাঁতার জানে না বলে সে নদীতে ভয়ে কেউ নামে না। এর চেয়ে ভালো খবর আর কি আছে?
কুমার হঠাৎ বিপুল আনন্দে একলাফ মেরে বলে উঠল, বুঝেছি, বুঝেছি, আর বলতে হবে না! উঃ, আমি কি বোকা! এতক্ষণ এই সহজ কথাটাও আমার মাথায় ঢোকেনি!
বিমল বললে, এই গর্তের ওপরে উঠে কোনও গতিকে একবার যদি সেই নদীতে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি, তাহলেই আমরা খালাস। দানবরা সাঁতার জানে না, কিন্তু আমরা সাঁতার জানি। নদীর স্রোতে ভেসে অন্ধকূপের বাইরে গিয়ে পড়ব।
বিনয়বাবু উৎসাহিত হয়ে বললেন, শাবাশ বিমল, শাবাশ! এত বিপদেও তুমি বুদ্ধি হারাওনি!
বিমল বললে, এখন মৃণুর ওপরেই সব নির্ভর করছে। সে যদি না আসতে পারে, তা হলেই আমরা গেলুম!
রামহরি বললে, তোমরা একটু চুপ করো খোকাবাবু, আমাকে বাবা মহাদেবের নাম জপ করতে দাও। বাবা মহাদেব তাহলে নিশ্চয়ই মুখ তুলে চাইবেন।
আচম্বিতে গর্তের ভিতরে একটা বিষম শব্দ হল–তারপরেই ভারী-ভারী পায়ের ধুপধুপ আওয়াজ!
অন্ধকারে পিছনে হটতে-হটতে বিমল চুপিচুপি বললে, সরে এসো। দেয়ালের দিকে সরে এসো। গর্তের ভেতরে শত্রু এসেছে।
গর্তের অন্য দিক থেকে অনেকগুলো লোক একসঙ্গে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল,–তার মধ্যে একজনের আর্তনাদ যেমন তীক্ষ্ণ, তেমনি মর্মভেদী। সে চিৎকার ক্রমে গর্তের ভিতর থেকে বেরিয়ে উপরে গিয়ে উঠল এবং তারপর ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে দূরে মিলিয়ে গেল!
বিনয়বাবু ভগ্নস্বরে বললেন, আজ আবার নরবলি হবে। আমাদের আর একজনকে আবার ছিনিয়ে নিয়ে গেল, কিন্তু আমরা কোনও বাধাই দিতে পারলুম না।
.
কাল সারা রাত গর্তের উপর থেকে রাক্ষুসে উৎসবের বিকট কোলাহল ভেসে এসেছে। এখনও সকাল হয়েছে কিনা বোঝবার উপায় নেই, কারণ এখানে আলোকের চিহ্ন নজরে পড়ে না।
তবে দানব-পুরী এখন একেবারে স্তব্ধ। এতেই অনুমান করা যায়, অন্ধকূপের বাইরে সূর্যদেব হয়তো এখন চোখ খুলে পৃথিবীর পানে দৃষ্টিপাত করেছেন।
বিমল, কুমার, বিনয়বাবু ও রামহরির সাগ্রহ দৃষ্টির সামনে গর্তের উপরে আবার কালকের মতো সেই মশালের আলো জ্বলে উঠল।
গর্তের উপরে মুখ বাড়িয়ে মৃদুস্বরে মৃণু ডাকলে, কুমারবাবু!
কুমার ছুটে গিয়ে সাড়া দিলে, মৃণু, এই যে আমি!
চুপ! চ্যাঁচাবেন না! শত্রুরা সব ঘুমিয়েছে! এই আমি দড়ি ঝুলিয়ে দিচ্ছি! দড়ি বয়ে তাড়াতাড়ি ওপরে আসুন।
বিমল বললে, কুমার, তুমিই আগে যাও, তারপর যাব আমরা। গর্তের আর সব লোককেও বলে রেখেছি, তারাও পরে যাবে।
কুমার দড়ি বয়ে উপরে গিয়ে উঠল। সেখানে এক হাতে বাঘাকে আর এক হাতে মশাল ধরে মৃণু উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। কুমার উপরে উঠতেই সে অগ্রসর হতে গেল।
কুমার বললে, একটু সবুর করো মৃণু, তোমার বাবাকে উপরে উঠতে দাও।
মৃণু বিস্মিত ভাবে বললে, আমার বাবা?
হ্যাঁ, কেবল তিনি নন, তোমার খোঁজে এসে আমার মতন বিমল আর রামহরিও বন্দি হয়েছে।
অ্যাঁ, বলেন কি।
ওই তোমার বাবা উপরে উঠলেন। দাও, বাঘাকে আমার হাতে দাও।
মৃণু ছুটে গিয়ে বিনয়বাবুর বুকের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
দেখতে-দেখতে রামহরি ও বিমলও উপরে এসে হাজির হল।
কিন্তু তারপরেই গর্তের ভিতর থেকে মহা হই-চই উঠল। গর্তের ভিতরে আর যে সব মানুষ বন্দি হয়ে ছিল, মুক্তিলাভের সম্ভাবনায় তারা যেন পাগল হয়ে গেল! তারা সকলেই একসঙ্গে দড়ি বয়ে উপরে আসবার জন্যে চাচামেচি ও পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিলে।