উপর থেকে সূর্যের একটি কিরণ-তির নিবিড় অন্ধকারের বুক বিদ্ধ করে গর্তের পাথুরে মেঝের উপরে এসে পড়ল।
বিনয়বাবু বললেন, কুমার, চটপট কাজ সেরে নাও! এ আলো এখনি পালাবে।
সূর্যরশ্মির সামনে কাগজের টুকরোগুলো ধরে কুমার দেখলে, একখানা ছোট ডায়েরি থেকে সেগুলো ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে। বোধহয় দানবদের হাতে ধরা পড়বার সময়েই ডায়েরিখানা মৃণুর কাছে ছিল।
ডায়েরির ছেঁড়া কাগজে পেনসিল লেখা রয়েছে–
কুমারবাবু, কী করে ধরা পড়েছি, সেকথা যদি দিন পাই, তবে বলব। কারণ আমার স্থান ও সময় দুই-ই অল্প।
তবে আপনিও যখন এদের হাতে ধরা পড়েছেন, তখন এরা যে কে ও কি-প্রকৃতির জীব, সেটা বোধহয় এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন।
যাদের কাছে আমি আছি, তারা মানুষ কিনা, আমি জানি না। তবে তাদের মুখ আর দেহ মানুষের মতন দেখতে বটে। এরা পরস্পরের সঙ্গে যখন কথা কয়, তখন এদের ভাষাও আছে। কিন্তু এদের ভাষায় কথার সংখ্যা খুবই কম।
কেবল ভাষা নয়, এদের একটা ধর্মও আছে। সে ধর্মের বিশেষ কিছুই আমি জানি না বটে, কিন্তু এরা যে সেই ধর্মের বিধি পালন করবার জন্যেই নানা জায়গা থেকে মানুষ ধরে আনে, এটুকু আমি বেশ বুঝতে পেরেছি!
কুমারবাবু, আপনি শুনলে অবাক হবেন, এদের প্রধান দেবতা হচ্ছে কুকুর! আর আমি কে জানেন? কুকুর-দেবতার প্রধান পূজারিনি। আমার এখানে আদর যত্নের অভাব নেই, সবাই আমাকে ভয়-ভক্তিও করে বোধহয়, কিন্তু এরা সর্বদাই আমাকে চোখে-চোখে রাখে, পাছে আমি পালিয়ে যাই, সেজন্যে চারিদিকেই কড়া পাহারার ব্যবস্থা আছে।
আমার থাকবার জন্যে এরা একটা আলাদা গুহারও ব্যবস্থা করেছে। সে গুহার ভিতরকার কোনও কোনও আসবাব ও জামাকাপড় আর আগেও দেওয়ালে আজেবাজে জিনিস দিয়ে আঁকা ছবি দেখে মনে হয়, আমার আগেও এখানে অন্য পূজারিণী ছিল এবং সেও আমারই মতন মানুষের মেয়ে।
বোধহয় এদের দেশে মানুষের মেয়ে ছাড়া আর কেউ পূজারিনি হতে পারে না। একজন পূজারিনির মৃত্যু হলে মানুষের দেশ থেকে আবার একজন মেয়েকে বন্দি করে আনা হয়।
প্রতি হপ্তায় একদিন করে এখানে বিশেষ পূজার ব্যবস্থা আছে। এখানকার আলো-ঝরনার ওপাশে আছে মস্ত এক নদী। সে নদী অত্যন্ত গভীর। এদেশের কেউ সাঁতার জানে না বলে সে-নদীতে ভয়ে কেউ নামে না। এদের ইঙ্গিতে যতটুকু বুঝেছি, সে নদীর নাকি আদিঅন্ত নেই। প্রতি হপ্তায় বিশেষ পূজার দিনে, কুকুর-দেবতাকে দিয়ে আমাকে সেই নদীর ধারে যেতে হয়, আর আমার সঙ্গে সঙ্গে আগে পিছে চলে দলে দলে এখানকার যত না-রাক্ষস, না-মানুষ, -বানর জীব নাচতে-নাচতে আর চাচাতে-চাঁচাতে। নদীর জলে কুকুর-দেবতাকে স্নান করিয়ে আবার ফিরে আসি এবং তারপর যা হয়,–উঃ, সে কথা আর বলবার নয়।
কুমারবাবু, এরা মানুষ চুরি করে আনে কেন, তা জানেন? কুকুর-দেবতার সামনে নরবলি দেওয়ার জন্যে! বলির পরে সেই মানুষের মাংস এরা সবাই ভক্ষণ করে। চোখের সামনে এই ভীষণ দৃশ্য দেখে আমার যে কি অবস্থা হয়, সেটা আপনি অনায়াসেই কল্পনা করতে পারবেন।
এমনি এক বিশেষ পূজার দিনে নদীর ধার থেকে ফিরে আসছি, আচম্বিতে কোথা থেকে মস্ত বড় একটা কুকুর এসে এখানকার কুকুর-দেবতার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল! তারপর দুই কুকুরে বিষম ঝটাপটি লেগে গেল। এখানকার কুকুরটা দেবতা হয়েও জিততে পারলে না, নতুন কুকুরের কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্তাক্ত দেহেই কেউ কেউ করে কাঁদতে কাঁদতে ল্যাজ গুটিয়ে কোথায় পালিয়ে গেল। নতুন কুকুরটা আমার কাছে এসে মনের খুশিতে ল্যাজ নাড়তে লাগল। তখন একটু আশ্চর্য হয়ে তার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখি, সে হচ্ছে আমাদেরই বাঘা।
বাঘা এখানে কেমন করে এল, অবাক হয়ে এই কথা ভাবতে-ভাবতে চোখ তুলেই আপনাকে দেখতে পেলুম। তখন আসল ব্যাপারটা বুঝতে আর দেরি লাগল না। আপনিও এদের কাছে বন্দি হয়েছেন।
বিজয়ী বাঘার বিক্রম দেখে এরা ভারী আনন্দিত হয়েছে। পরাজিত কুকুরটাকে তাড়িয়ে দিয়ে বাঘাকেই এরা দেবতা বলে মেনে নিয়েছে। এবার থেকে আমাকে বাঘার পূজা করতে হবে।
কুমারবাবু, এখন আমাদের উপায় কী হবে? এই ভীষণ দেশ ছেড়ে আর কি আমরা স্বদেশে ফিরতে পারব না? আমাকে হারিয়ে না জানি আমার বাবার অবস্থা কি হয়েছে।
আজ বলির নরমাংস খেয়ে এরা সারারাত উৎসব করবে। কাল সকালে এরা অনেকেই ঘুমিয়ে পড়বে। যারা পাহারা দেবে তারাও বিশেষ সজাগ থাকবে না। সেই সময়ে আমি আবার চুপিচুপি আপনার গর্তের ধারে যাওয়ার চেষ্টা করব।
এখানে একরকম শক্ত লতা পাওয়া যায়, তাই দিয়ে আমি একগাছা লম্বা ও মোটা দড়ি তৈরি করছি। গর্তের ভিতরে সেই দড়ি ঝুলিয়ে দিলে হয়তো আপনি উপরে উঠেও আসতে পারবেন।
আমাদের অদৃষ্টে কি আছে জানি না, কিন্তু কাল আমরা মুক্তিলাভের চেষ্টা করবই–তারপর কপালে যা থাকে তাই হবে।
আপনি প্রস্তুত হয়ে থাকবেন।
ইতি মৃণু।
.
বারো । অন্ধকূপের নদী
কুমারের পত্রপাঠ শেষ হল।
বিনয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, এতদিন পরে আমার হারানো মেয়েকে পেয়ে মনে খুব আনন্দ হচ্ছে বটে, কিন্তু এ আনন্দের কোনও দাম নেই।
কুমার বললে, কেন বিনয়বাবু? মৃণু তো খুব সুখবরই দিয়েছে। কাল সকালে সে লতা দিয়ে দড়ি তৈরি করে আনবে বলেছে। আমাদের আর এই অন্ধকূপে পচে মরতে হবে না।