হিমালয়ের ঊর্ধ্ব ভাগ থেকে রাশি রাশি পচা গাছপাতা ও অন্যান্য আজেবাজে জিনিস পাহাড়ের দুইপাশে নেমে এসে জমা হয়ে থাকত। কালে সেইসব জায়গা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের (mammals) বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এখানে তাই আজও এত আদিম জীব-জন্তুর শিলীভূত কঙ্কাল পাওয়া যায় যে, পণ্ডিতেরা এ-জায়গাটাকে সেকেলে জীবদের গোরস্থান বলে ডেকে থাকেন।
কিছুদিন আগে Yale North India Expedition-এর পণ্ডিতরা উত্তর-ভারত থেকে অনেক নতুন তথ্য আবিষ্কার করেছেন। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে মানুষের মতন দেখতে এক নতুন জাতের বানরের অস্তিত্ব!
ওই অভিযানে দলপতি ছিলেন অধ্যাপক Hellmut de Terra সাহেব। উত্তর-ভারতবর্ষে এক বৎসর কাল তিনি অনেক অনুসন্ধান ও পরীক্ষা করেছেন। তার পরীক্ষার ফলে যে-সব দেহাবশেষ পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে কোনও-কোনওটিকে দেখতে প্রায় মানুষের মতন। অন্তত গরিলা ওরাং ওটাং বা শিম্পাঞ্জি বানরদের সঙ্গে তাদের দেহের গড়ন মেলে না। এইরকম দুই জাতের অজানা জীবের নাম দেওয়া হয়েছে Ramapitheeus ও Sugrivapitheeus। নাম শুনলেই তোমরা বুঝতে পারবে যে, রামচন্দ্র ও সুগ্রীবের নামানুসারেই তাদের নামকরণ হয়েছে।
পণ্ডিতদের মতে, উত্তর-ভারতে প্রাপ্ত এইসব জীবের কোনও-কোনওটির মস্তিষ্ক, গরিলা প্রভৃতি সমস্ত মানব জাতীয় জীবের মস্তিষ্কের চেয়ে উন্নত। তাদের মস্তিষ্কের শক্তি ছিল অনেকটা মানুষেরই কাছাকাছি।
কে বলতে পারে, ওইসব জীবের কোনও কোনও জাতি এখনও হিমালয়ের কোনও গোপন প্রান্তে বিদ্যমান নেই? তারা সভ্যতার সংস্পর্শে আসবার সুযোগ পায়নি বলে আধুনিক মানুষ তাদের খবর রাখে না। কিন্তু আমরা জানি না বলেই যে তারা বেঁচে নেই, এমন কথা কিছুতেই মনে করা চলে না। হয়তো তারা বেঁচে আছে এবং হয়তো তারা সভ্য না হলেও মস্তিষ্কের শক্তিতে আগেকার চেয়ে উন্নত হয়ে উঠেছে।
বিমল, কুমার! আর যা জানি আর মনে করি, সব তোমাদের কাছে খুলে বললুম। তবে আমার অনুমানই সত্য বলে তোমরা গ্রহণ না করতেও পারো।
বিমল বললে, তাহলে আপনার মত হচ্ছে, মানুষের মতন দেখতে বানর-জাতীয় দানবরাই আমাদের সকলকে বন্দি করে রেখেছে?
বিনয়বাবু মৃদুস্বরে জবাব দিলেন, বললুম তো, ওটা আমার মত না, আমার অনুমান মাত্র।
কুমার বাহুকেই বালিশে পরিণত করে কঠিন পাথরের উপরে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবছে।
বিমল প্রভৃতির মুখেও কোনও কথা নেই! চারিদিক যেমন স্তব্ধ, তেমনি অন্ধকার।
হঠাৎ কুমারের মনে হল, অন্ধকারের বুক ছাদা করে যেন ছোট্ট একটি আলো-শিশু কাঁপতে কাঁপতে হেসে উঠল।
প্রথমটা কুমার ভাবলে, তার চোখের ভুল। কিন্তু ধড়মড়িয়ে উঠে বসে ভালো করে চেয়ে সে বুঝলে, সে আলো একটা মশালের আলো! গর্তের উঁচু পাড়ের ধারে দাঁড়িয়ে কেউ মশাল হাতে নিয়ে কি দেখছে! মশালের তলায় একখানা অস্পষ্ট মুখও দেখা গেল কুমারের মনে হল সে মুখ যেন তারই মতন সাধারণ মানুষের মুখ!
কে যেন উপর থেকে চাপা অথচ স্পষ্ট গলায় ডাকলে, কুমারবাবু! কুমারবাবু!
এ যে নারীর কণ্ঠস্বর। নিজের কানের উপরে কুমারের অবিশ্বাস হল–এই রাক্ষসের মুল্লুকে মানুষের মেয়ে।
.
এগারো । কুকুর-দেবতার মুল্লুক
কেবল কি মানুষের মেয়ে? এ মেয়ে যে তারই নাম ধরে ডাকছে।
কুমার ভাবলে, হয়তো সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে!
আবার উপর থেকে চাপা গলার আওয়াজ এল–কুমারবাবু!
এবারে কুমার আর চুপ করে থাকতে পারলে না, চাপা গলায় উত্তর দিলে, কে?
উপর থেকে সাড়া এল, ঠিক আমার নীচে এসে দাঁড়ান।
কুমার কথামতো কাজ করলে।
এইটে নিন!
কুমারের ঠিক পাশেই খট করে কি একটা শব্দ হল। গর্তের তলায় হাত বুলিয়ে কুমার জিনিসটা তুলে দিলে। অন্ধকারেই অনুভবে বুঝলে, একখণ্ড পাথরের সঙ্গে সংলগ্ন কয়েক টুকরো কাগজ। উপরে মুখ তুলে দেখলে, সেখানে আর মশালের আলো নেই।…আস্তে আস্তে ডাকল, বিমল!
বিমল বললে, হ্যাঁ, আমরাও সব দেখেছি, সব শুনেছি।
বিনয়বাবু বললেন, কুমার, তুমি মৃণুকে চিনতে পারলে না?
কুমার সবিস্ময়ে বললে, মৃণু! যে আমাকে ডাকলে, সে কি মৃণু? আপনি চিনতে পেরেছেন?
বাপের চোখ নিজের সন্তানকে চিনতে পারবে না?
কিন্তু কি আশ্চর্য! যার খোঁজে এতদুর আসা, তাকে পেয়েও আপনি তার সঙ্গে একটা কথাও কইলেন না?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিনয়বাবু বললেন, কত কষ্টে যে নিজেকে সামলেছি, তা কেবল আমিই জানি কুমার! কিন্তু কী করব বলো? যখন দেখলুম এই শত্ৰুপুরীতে আমার মেয়ের ভয়ে ভয়ে চাপা-গলায় তোমাকেই ডাকছে, তখন নিজের মনের আবেগ জোর করে দমন না করলে মৃণুকে হয়তো বিপদে ফেলা হত!
বিমল বললে, দেখুন বিনয়বাবু, আমার বিশ্বাস আপনি আর আমি যে আছি, মৃণু তা জানে না। খুব সম্ভব, কেবল কুমারকেই সে দেখতে পেয়েছে, তাই তাকে ছাড়া আর কারুকে ডাকেনি।
বিনয়বাবু বললেন, বোধহয় তোমার কথাই ঠিক।
কুমার বললে, মৃণু কতকগুলো টুকরো কাগজ দিয়ে গেল, নিশ্চয় তাতে কিছু লেখা আছে। কিন্তু এই অন্ধকারে কেমন করে পড়ব? আমার টর্চ গর্তে পড়বার সময় ভেঙে গেছে।
বিনয়বাবু বললেন, কাল আমি দেখেছি, পাহাড়ের এক ফাটল দিয়ে কোনও এক সময়ে এই গর্তের ভিতরে সূর্যরশ্মির একটা রেখা কিছুক্ষণের জন্যে এসে পড়ে। আজও নিশ্চয় সেই আলোটুকু পাওয়া যাবে। অপেক্ষা করো।