হঠাৎ সে চমকে উঠল! অন্ধকারে পায়ের শব্দ হচ্ছে।
কুমার একলাফে দাঁড়িয়ে উঠেই শুনলে–কুমার, তোমার কি বেশি চোট লেগেছে?
এ যে বিনয়বাবুর গলা!
বিপুল বিস্ময়ে কুমার বলে উঠল, বিনয়বাবু! আপনি?
হা কুমার, আমি।
আমিও এখানে আছি কুমার!
অ্যাঁ! বিমল! তুমি তাহলে বেঁচে আছ!
হ্যাঁ ভাই, আমি বেঁচে আছি, রামহরিও বেঁচে আছে, আরও অনেকেও বেঁচে আছে। কিন্তু আর বেশিদিন কারুকেই বাঁচতে হবে না। দিনে দিনে আমাদের দল থেকে ক্রমেই লোক কমে যাচ্ছে। মৃত্যুর স্বপ্ন দেখতে-দেখতে আমরা বেঁচে আছি!
কি বলছ বিমল, তোমার কথা যে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
একে একে সব কথাই শুনতে পাবে। আগে তোমার কথাই বলো।
.
দশ। অন্ধকারের বুকে আলোর শিশু
কুমার নিজের সব কথা বিমলের কাছে বলে জিজ্ঞাসা করলে, কিন্তু তোমরা সবাই কেমন করে এখানে এসে মিললে?
বিমল বললে, আমাদের ইচ্ছায় এ মিলন হয়নি। এ মিলন ঘটিয়েছে শত্রুরাই।
বিমল, তোমার কথা আমার কাছে হেঁয়ালির মতন লাগছে। আমাকে সব বুঝিয়ে দাও।
এর মধ্যে বোঝাবুঝির কিছু নেই কুমার। কাদের হাতে আমরা বন্দি হয়েছি, তা তুমি জানো। কখন আমরা বন্দি হয়েছি, তাও তুমি জানো। এখন আমরা কোথায় আছি তাও তোমার অজানা নয়।
না বিমল, এখন আমরা কোথায় আছি, তা আমার জানা নেই, চারিদিকে যে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।
বিমল বললে, এটা একটি মস্ত বড় লম্বা-চওড়া গর্ত।
বিনয়বাবু বললেন, আর, এই গর্তটা হচ্ছে আমাদের শত্রুদের বন্দিশালা।
বন্দিশালা?
হ্যাঁ। শত্রুরা আমাদের এখানে বন্দি করে রেখেছে। তুমি যেচে এই কারাগারে এসে ঢুকেছ। এর চারিদিকে খাড়া পাথরের উঁচু দেওয়াল। এখান থেকে পালাবার কোনও উপায়ই নেই।
একটু তফাত থেকে রামহরির কাতরকণ্ঠ শোনা গেল–ভূতের জেলখানা! বাবা মহাদেব। রোজ তোমার পূজো করি, এই কি তোমার মনে ছিল বাবা?
কুমার বললে, তাহলে শত্রুরা তোমাদের সকলকে একে একে ধরে এনে এইখানে বন্ধ করে রেখেছে?
বিমল বললে, হ্যাঁ। খালি আমরা নই, আমাদের সঙ্গে এই গর্তের মধ্যে আরও অনেক পাহাড়ি লোকও বন্দি হয়ে আছে। দার্জিলিং আর হিমালয়ের নানান জায়গা থেকে তাদের ধরে আনা হয়েছে।
এর মধ্যে মৃণু নেই?
না। মৃণু কেন, এই গর্তের ভেতরে কোনও মেয়েই নেই! তবে মেয়েদের জন্যে আলাদা বন্দিশালা আছে কিনা জানি না।
এ যে এক অদ্ভুত রহস্য! আমাদের বন্দি করে রাখলে এদের কি উপকার হবে?
তা জানি না। কিন্তু বন্দি পাহাড়িদের মুখে শুনলুম, প্রতি হপ্তায় একজন করে বন্দিকে ওরা গর্ত থেকে বার করে নিয়ে যায়। যে বাইরে যায়, সে নাকি আর ফেরে না।…কুমার এই ব্যাপার থেকে তুমি অনেক কিছুই অনুমান করতে পারো।
কুমার শিউরে উঠে বললে, কী ভয়ানক! ওরা কি তবে প্রতি হপ্তায় একজন করে মানুষকে হত্যা করে?
আমার তো তাই বিশ্বাস। হঠাৎ একদিন তোমার কি আমার পালা আসবে। এস, সেজন্যে আমরা আগে থাকতেই প্রস্তুত হয়ে থাকি।
সে কী বিমল, আমরা কি কোনওই বাধা দিতে পারি না?
না। সিংহের সামনে ভেড়া যেমন অসহায়, ওদের সামনে আমরাও তেমনি। ওদের চেহারা তুমিও দেখেছ, আমিও দেখেছি। ওদের একটা কড়ে আঙুলের আঘাতেই আমাদের দফা রফা হয়ে যেতে পারে। বাধা দিয়ে লাভ?
কুমার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে, ওরা কে বিমল? রূপকথায় আর আরব্য-উপন্যাসে দৈত্য-দানবের কথা পড়েছি। কিন্তু তারা কি সত্যই পৃথিবীর বাসিন্দা?
কুমারের আরও কাছে সরে এসে বিমল বললে, কুমার, তাহলে শোনো। আরব্য-উপন্যাসে দৈত্য-দানবরা সত্যি কি মিথ্যে, তা আমি বলতে পারব না বটে, কিন্তু পৃথিবীতে এক সময়ে যে দৈত্যের মতন প্রকাণ্ড মানুষ ছিল, একথা আমি মনে-মনে বিশ্বাস করি। মাঝে মাঝে সে প্রমাণও পাওয়া যায়। তুমি কি জানো না, এই ভারতবর্ষেই কাটনির কাছে একটি ৩১ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা বিরাট কঙ্কাল পাওয়া গেছে? তার পা দুটোই ১০ ফুট করে লম্বা। সে কঙ্কালটা প্রায় মানুষের কঙ্কালের মতোই দেখতে। রামগড়ের রাজার প্রাসাদে কঙ্কালটা রাখা হয়েছে। আমি স্টেটসম্যানে এই খবরটা পড়েছি।
বিনয়বাবু বললেন, দেখো, দার্জিলিংয়ের সুরেনবাবুর কাছে গিয়ে যেদিন ইন্ডিয়ান ডেলি। নিউজের পুরোনো ফাইলে হিমালয়ের রহস্যময় জীবের কথা পড়লুম, সেইদিন থেকে অনেক কথাই আমার মনে হচ্ছে। এর আগেও কোনও কোনও ভ্রমণ কাহিনিতে আমি হিমালয়ের ঘৃণ্য তুষার-মানবের কথা পড়েছি। ইন্ডিয়ান ডেলি নিউজে হয়তো তাদেরই কথা বেরিয়েছে। কিন্তু আসলে কে তারা? তারা কি সত্যিই মানুষ, না মানুষের মতন দেখতে অন্য কোনও জীব? আধুনিক পণ্ডিতদের নতুন নতুন আবিষ্কারের ভিতরে খুঁজলে হয়তো এ-প্রশ্নের একটা সদুত্তর পাওয়া যেতে পারে।
কুমার সুধোলে, আমাদের চেয়ে আপনার পড়াশুনো ঢের বেশি। আপনি কোনও সদুত্তর পেয়েছেন কি?
বিনয়বাবু বললেন, সে-বিষয়ে আমি নিজে জোর করে কিছু বলতে চাই না। তবে পণ্ডিতদের আবিষ্কারের কথা আমি তোমাদের কাছে বলতে পারি, শোনো।
পণ্ডিতদের মতে, এখন যেখানে হিমালয় পর্বত আছে, অনেক লক্ষ বৎসর আগে মহাসাগরের অগাধ জল সেখানে খেলা করত। কারণ আধুনিক হিমালয়ের উপরে অসংখ্য সামুদ্রিক জীবের শিলাভূত কঙ্কাল বা দেহাবশেষ অর্থাৎ fassil পাওয়া গিয়েছে।
হিমালয়ের আশেপাশে যেসব দেশ আছে, এখনও ধীরে-ধীরে তারা ক্রমেই উঁচু হয়ে উঠছে। হিসাব করে দেখা গেছে, কাশীধামের উত্তরদিকে ভূমি এখনও প্রতি শতাব্দীতেও ৬ ফুট করে উঁচু হয়ে উঠছে।