.
কিন্তু গোলমালটা ক্রমেই তার কাছে এসে পড়ল। আবছায়ার ভিতরে জেগে উঠল দলে দলে কতকগুলো সৃষ্টি ছাড়া অতি ভয়ঙ্কর মূর্তি…এতদূর থেকে তাদের ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না বটে, কিন্তু তাদের অমানুষি দেহের বিশালতা যে বিস্ময়কর, এটুকু অনায়াসেই আন্দাজ করা যায়।
কুমার তাড়াতাড়ি বাঘাকে টেনে নিয়ে যে-পথে এসেছিল সেইদিকে ফিরতে গেল– কিন্তু ফিরেই দেখলে তার পালাবার পথ জুড়ে খানিক তফাতে তেমনি বীভৎস এবং তেমনি ভয়ংকর অনেকগুলো অসুরের মূর্তি সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে, দুঃস্বপ্নের মতো।
সে ফিরে আর একদিকে দৌড়ে গেল। কিন্তু বেশিদূর যেতে হল না, সেদিকেও অন্ধকারের ভিতর থেকে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এল আরও কতকগুলো মূর্তিমান বিভীষিকা! প্রত্যেক মূর্তিই মাথায় হাতির মতন উঁচু!
এতক্ষণ সকলে আঁধারে গা ঢেকে ওত পেতে ছিল, এইবারে সময় বুঝে চতুর্দিক থেকে আত্মপ্রকাশ করে তারা কুমারকে একেবারে ঘিরে ফেললে!
বাঘাও আর চাঁচালে না, সেও যেন হতভম্ব হয়ে গেল।
গুহার অন্ধকার এখন কুমারের চোখের ভিতরে এসে তার দৃষ্টিকেও অন্ধকার করে দিলে।
.
নয়। অন্ধকারের গর্তে
কী ভয়ানক, কী ভয়ানক! মাথায় হাতির সমান উঁচু, দেখতে মানুষের মতন, কিন্তু কী বিভীষণ আকৃতি! তাদের সর্বাঙ্গে গরিলার মতন কালো কালো লোম এবং তাদের ভঁটার মতন চোখগুলো দিয়ে হিংস্র ও তীব্র দৃষ্টি বেরিয়ে এসে কুমারের স্তম্ভিত মনকে যেন দংশন করতে লাগল।
সেই অমানুষিক মানুষদের মধ্যে পুরুষও আছে, স্ত্রীলোকও আছে, কিন্তু সকলেই সম্পূর্ণ উলঙ্গ!
কুমার লক্ষ্য করে দেখলে, দূর থেকে সার বেঁধে অসংখ্য মূর্তি দ্রুতপদে এগিয়ে আসছে ঠিক যেন মিছিলের মতো। সেই বীভৎস মূর্তিগুলোই হাত তুলে লাফাতে লাফাতে চিৎকার করছে। আর মনে হচ্ছে, যেন অনেকগুলো স্টিমার একসঙ্গে কু দিচ্ছে!…কোন জীবের কণ্ঠ থেকে যে অমন তীক্ষ্ণ এবং উচ্চ আওয়াজ বেরুতে পারে সেটা ধারণা করাই অসম্ভব!
কিন্তু কীসের ওই মিছিল? প্রথমটা কুমার ভাবলে, হয়তো ওরা তাকেই আক্রমণ করতে আসছে। কিন্তু তারা যখন আরও কাছে এগিয়ে এল, তখন বেশ বোঝা গেল, ও-দলের কারুর দৃষ্টি কুমারের দিকে নেই। নিজেদের খেয়ালে তারা নিজেরাই মত্ত হয়ে আছে।
চারিদিকের অন্ধকারের ভিতর থেকে এতক্ষণে আরও যে-সব অপরূপ মূর্তি একে একে বেরিয়ে আসছিল, তারাও এখন যেন কুমারের অস্তিত্বের কথা একেবারেই ভুলে গেল,–অত্যন্ত কৌতূহলের সঙ্গে সেই মিছিলের দিকে তাকিয়ে তারাও সবাই হাত-পা ছুঁড়ে লাফাতে লাফাতে তেমনি বিকট স্বরে চিৎকার জুড়ে দিলে! এ কী ব্যাপার? কেন এত লম্ফ-ঝম্প, আর কেনই বা এত হট্টগোল?
কুমার কিছুই বুঝতে পারলে না বটে, কিন্তু আর একটা নতুন ব্যাপার আবিষ্কার করলে। সেই বিরাট মিছিলের আগে আগে মিশমিশে কালো কি একটা জীব আসছে! কী জীব ওটা? কুকুর বলেই তো মনে হয়!
কুমারের দৃষ্টি যখন মিছিল নিয়েই ব্যস্ত হয়ে আছে, তখন হঠাৎ একটা অভাবিত কাণ্ড ঘটে গেল। এখানকার এই অদ্ভুত মানুষগুলোকে দেখে বাঘা এতক্ষণ ভ্যাবাচাকা খেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল বটে, কিন্তু নিজেদের জাতের নতুন একটি নমুনা দেখে তার সে-ভাব আর রইল না,–আচম্বিতে এক হ্যাঁচকা টান মেরে শিকলসুদ্ধ কুমারের হাত ছাড়িয়ে সে সেই মিছিলের কুকুরটার দিকে ছুটে গেল, তিরের মতন বেগে!
এর জন্যে কুমার মোটেই প্রস্তুত ছিল না, কাজেই বাঘাকে সে নিবারণ করতেও পারলে না।
তারপর কী যে হল কিছুই বোঝা গেল না কারণ সেই দানবমানুষগুলো চারিদিক থেকে ব্যস্তভাবে ছুটে এসে বাঘাকে একেবারে তার চোখের আড়াল করে দিলে!
কুমার বুঝলে, বাঘার আর কোনও আশাই নেই, এই ভয়াবহ জীবগুলোর কবল থেকে বাঘাকে সে আর কিছুতেই উদ্ধার করতে পারবে না!
হঠাৎ আর একদিকে তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। একটা ভীষণ দানবমূর্তি তার দিকেই বেগে এগিয়ে আসছে। কুমার সাবধান হওয়ার আগেই সে তার ঘাড়ের উপর এসে পড়ল এবং তাকে ধরবার জন্যে কুলোর মতন চ্যাটালো একখানা হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিলে।…কুমার টপ করে মাটির উপর বসে পড়ল এবং সেই অসম্ভব হাতের বাঁধনে ধরা পড়বার আগেই নিজের কোমরবন্ধ থেকে রিভলভারটা খুলে নিয়ে তিন-চারবার গুলিবৃষ্টি করলে। গুলি খেয়ে দানবটা ভীষণ আর্তনাদ করে কয়েক পা পিছিয়ে গেল এবং সেই ফাঁকে কুমার দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে প্রাণপণে দৌড়োতে লাগল।
দৌড়োতে-দৌড়োতে কুমার আবার নিবিড় অন্ধকারের ভিতর এসে পড়ল। দৌড়ে কোথায় যাচ্ছে সে তা বুঝতে পারলে না বটে, কিন্তু তার পিছনে পিছনে মাটির উপরে ভারী ভারী পা ফেলে সেই আহত ও ক্রুদ্ধ দানবটা যে ধেয়ে আসছে এটা তার আর জানতে বাকি রইল না।
আচম্বিতে কুমারের পায়ের তলা থেকে মাটি যেন সরে গেল, দুই হাতে অন্ধকার শূন্যকে আঁকড়ে ধরার জন্যে সে একবার বিফল চেষ্টা করলে এবং পরমুহূর্তে কঠিন পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ে সমস্ত জ্ঞান হারিয়ে ফেললে!
কতক্ষণ পরে তার জ্ঞান হল সে তা জানে না। কিন্তু চোখ খুলে সে আবার দেখলে তেমনি ছিদ্রহীন অন্ধকারেই চারিদিক আবার সমাধির মতোই স্তব্ধ, দানবের কোনও সাড়াই আর কানে আসে না। এদিকে-ওদিকে হাত বুলিয়ে অনুভবে বুঝলে, সে পাহাড়ের গায়েই শুয়ে আছে। আস্তে আস্তে উঠে বসল। দু-চারবার হাত-পা নেড়ে-চেড়ে দেখলে তার দেহের কোনও জায়গা ভেঙে গেছে কিনা!