এমনি ভাবতে ভাবতে কুমার প্রায় আধ মাইল পথ এগিয়ে গেল। তখনও গুহা শেষ হল না।
এখনও বাঘা মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে চাপা গর্জন করছে বটে, কিন্তু এখন তার ভাব-ভঙ্গিতে কুমার একটা নতুনত্ব লক্ষ করলে।
বাঘা তখন আর ডাইনে-বাঁয়ে বা সামনের দিকে তাকাচ্ছে না–বারবার দাঁড়িয়ে সে। পিছনপানে ফিরে দেখছে আর গর্জন করে উঠছে! যেন শত্রু আছে পিছনদিকেই। এ সময়ে কুমারের মনের ভিতরটা যে কীরকম করছিল, তা আর বলবার নয়।
আর-একটা ব্যাপার তার নজরে পড়ল! টর্চের আলোতে সে দেখতে পেলে, তার ডাইনে আর বাঁয়ে গুহার কালো পাথুরে গা দেখা যাচ্ছে। তাহলে গুহাটা ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছে!
আরও খানিকটা এগুবার পর গুহার দুদিকের দেওয়াল তার আরও কাছে এগিয়ে এল। এখন সে যেন একটা হাত-পনেরো চওড়া পথ দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
আরও কিছুপরেই মনে হল, সামনের দিকের অন্ধকার যেন একটু পাতলা হয়ে এসেছে। কয়েক পা এগিয়ে আলো ফেলে দেখা গেল, গুহাপথ সেখানে ডানদিকে মোড় ফিরেছে।
মোড় ফিরেই কুমার সবিস্ময়ে দেখলে, গুহার পথ আবার ক্রমেই চওড়া এবং ঢালু হয়ে নীচের দিকে নেমে গিয়ে আর একটা বিরাট গুহার সৃষ্টি করেছে!
এ গুহা অন্ধকার নয়, আলো-আঁধারিতে এখানকার খানিকটা দেখা যাচ্ছে এবং খানিকটা দেখা যাচ্ছে না! সন্ধ্যার কিছু আগে পৃথিবী যেমন আলোছায়ার মায়াভরা হয়, এই নতুন গুহার ভিতরে ঠিক তেমনিধারাই আলো আর ছায়ার লীলা দেখা যাচ্ছে!
এই আলো-আঁধারির পরে একদিকে ঠিক আগেকার মতোই নিরেট অন্ধকার বিরাজ করছে। এবং আর একদিকে–অনেক তফাতে উপর থেকে একটা উজ্জ্বল আলোকের ঝরনা ঝরে পড়ছে। অর্থাৎ এখানে একদিক থেকে আসছে অন্ধকারের স্রোত এবং আর একদিক থেকে আসছে। আলোকের ধারা,–এই দুইয়ে মিলেই এখানকার বিচিত্র আলোছায়ার সৃষ্টি হয়েছে!
আচম্বিতে এই নতুন গুহার ভিতরে দূরে থেকে নিবিড় অন্ধকারের দিক থেকে জেগে উঠল মানুষের মর্মভেদী আর্তনাদ। অত্যন্ত যন্ত্রণায় কে যেন তীক্ষ্ণ স্বরে কেঁদে উঠল। তারপরেই সব চুপচাপ!
কার এ কান্না? নিশ্চয় বিমলের নয়, কারণ মৃত্যুর মুখে পড়লেও বিমল যে কোনওদিনই কাতরভাবে কাঁদবে না, কুমার তা জানত। মঙ্গলগ্রহে ও ময়নামতীর মায়াকাননে গিয়ে বিনয়বাবুর সাহসও সে দেখেছে, তিনিও এমন শিশুর মতন কাঁদবেন বলে মনে হয় না। তবে কি রামহরি বেচারিই এমনভাবে কেঁদে উঠল? অসম্ভব নয়। তার বুকের পাটা থাকলেও ভূতের ভয়ে সে সব করতে পারে! হয়তো কল্পনায় ভূত দেখে সে ককিয়ে উঠেছে!…না, কল্পনাই বা বলি কেন, আজ সকালেই আমার চোখের উপরে যে-হাতের বাঁধনে বিমল বন্দি হয়েছে, সে কি মানুষের হাত?
কিন্তু এ আর্তনাদ যারই হোক, তার উৎপত্তি কোথায় এবং কোনদিকে? ভালো করে বোঝবার আগেই সেই আর্তনাদ থেমে গেল–কেবল গুহার বিরাট গর্তের মধ্যে সেই একই কণ্ঠের আর্তনাদ প্রতিধ্বনির মহিমায় বহুজনের কান্নার মতন চারিদিক অল্পক্ষণ তোলপাড় করে আবার নীরব হল। গুহার মধ্যে আবার অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা–নিজের হৃৎপিণ্ডের দুপদুপুনি নিজের কানেই শোনা যায়।
.
কুমার খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলে যদি আবার সেই কান্না শোনা যায়! কিন্তু কান্না আর শোনা গেল না।
তখন কুমার বাঘাকে ডেকে শুধোলে, হ্যাঁ রে বাঘা, এবারে কোনদিকে যাব বল দেখি!
বাঘা যেন মনিবের কথা বুঝতে পারলে। সে একবার ল্যাজ নাড়লে। একবার পিছনপানে চেয়ে গরর-গরর করলে, তারপর ফিরে পাহাড়ের ঢালু গা বয়ে নীচের দিকে নামতে লাগল।
বাঘার অনুসরণ করতে করতে কুমার নিজের মনে-মনেই বলতে লাগল, বাঘার বারবার পিছনে ফিরে তাকানোটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না। শত্রুরা নিশ্চয়ই আমার পালাবার পথ বন্ধ করেছে। এখন সামনের দিকে এগুনো ছাড়া আমার আর কোনও উপায় নেই। প্রাণ। নিয়ে ফেরবার কোনও আশাই দেখছি না,–এখন মরবার আগে একবার খালি বিমলের মুখ দেখতে চাই।
..গুহার মেঝে আর ঢালু নেই, সমতল। কুমার আলোকের সেই ঝরনার দিকে এগিয়ে চলল। চারিদিকে আগে অন্ধকারের বেড়াজাল তারপর আবছায়ার মায়া এবং তারই মাঝখানে সেই আলো-নিঝর ঝরে পড়ছে, যেন দয়ালু আকাশের আশীর্বাদ! কী মিষ্টি সে আলো! কুমার আন্দাজে বুঝলে, গুহার ছাদে নিশ্চয় কোথাও একটা বড় ফাঁক আছে!
হঠাৎ অনেকদূর থেকে অদ্ভুত একটা শব্দ জেগে উঠল!
কুমার চমকে উঠে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। বাঘাও উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগল।
শব্দটা প্রথমে অস্পষ্ট ছিল, তারপরে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। তারপর শব্দ যখন আরও কাছে এসে পড়ল, কুমারের গা তখন শিউরে উঠল।
এ শব্দ যেন তার পরিচিত। কাল রাত্রেই সে যে এই শব্দ শুনেছে! এ যেন স্টিমার কু দিচ্ছে। একটা-দুটো নয়, অনেকগুলো–যেন শত শত স্টিমার একসঙ্গে কু দিতে-দিতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সেই উদ্ভট ও বীভৎস ঐকতান ক্রমেই তীক্ষ্ণ ও তীব্র হয়ে উঠে সমস্ত গুহাকে পরিপূর্ণ করে ফেললে এবং তার সঙ্গে যোগ দিলে চারিদিক থেকে অসংখ্য প্রতিধ্বনি। সেই শান্ত ও স্তব্ধ গুহা দেখতে-দেখতে যেন এক শব্দময় নরক হয়ে উঠল। বাঘাও পাল্লা দিয়ে চাঁচাতে শুরু করলে কিন্তু অনেকগুলো তোপের কাছে সে যেন একটা ধানি পটকার আওয়াজ মাত্র!
এই ভয়াবহ গোলমালের হেতু বুঝতে না পেরে কুমার কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতন দাঁড়িয়ে রইল, খানিকক্ষণ।