সেইখানে বসে পড়ে কুমার ফ্লাস্ক থেকে জলপান করে আগে নিজের প্রবল তৃষ্ণাকে শান্ত করলে। বাঘাও করুণ ও প্রত্যাশী চোখে তার মুখের পানে তাকিয়ে আছে দেখে তাকেও জলপান করতে দিলে।
তারপর চারিদিকে তাকিয়ে দেখলে, সে কী দৃশ্য! একদিকে পর্বত-সমুদ্রের প্রস্তরীভূত স্থির তরঙ্গদল দৃষ্টিসীমা জুড়ে আছে এবং তারপরেই কাঞ্চনজঙ্ঘার সুগম্ভীর চির-তুষারের রাজ্য! আর একদিকে বনশ্যামল পাহাড়ের দেহ পৃথিবীর দিকে দিকে নেমে গিয়েছে এবং উজ্জ্বল রুপোর একটি সাপের মতন রঙ্গিত-নদী এঁকেবেঁকে খেলা করতে করতে কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে, এত উঁচু থেকে তার কল-গীতিকা কানে আসে না।
আশেপাশে, কাছে-দূরে সরল ও সিন্দুর গাছেরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও ম্যাগ্নোলিয়া এবং কোথাও বা রোডোডেনড্রন ফুল ফুটে মর্তের সামনে স্বর্গের কল্পনাকে জাগিয়ে তুলেছে।
কিন্তু এমন মোহনীয় সৌন্দর্য উপভোগ করবার মতন চোখ ও সময় কুমারের তখন ছিল না। এবং বাঘার লক্ষ্য এসব কোনওদিকেই নেই–তার চেষ্টা কেবল এগিয়ে যাওয়ার জন্যেই।
খানিকক্ষণ হাঁপ ছেড়ে কুমার আবার উঠে পড়ে অগ্রসর হল।
ঘণ্টাখানেক পথ চলবার পরেই দেখা গেল, পথের সামনেই পাহাড়ের একটা উঁচু, খাড়া গা দাঁড়িয়ে আছে। কুমার ভাবতে লাগল, তাহলে এ-পথটা কি ওইখানেই গিয়ে শেষ হয়েছে। কিন্তু ওখানে তো আর কোনও কিছুরই চিহ্ন নেই। তবে কি আমি ভুল পথে এসেছি,এত পরিশ্রম একেবারেই ব্যর্থ হবে?
সেই খাড়া পাহাড়ের কাছে এসে কুমার দেখলে, না, পথ শেষ হয়নি–ওই খাড়া পাহাড়ের তলায় এক গুহা,–পথটা তার ভিতরেই ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেছে!
তবে কি ওই গুহাটাই হচ্ছে সেই রাক্ষুসে জীবদের আস্তানা?
বাহির থেকে উঁকি-ঝুঁকি মেরে কুমার গুহার ভিতরে কিছুই দেখতে পেলে না–তার ভিতরে স্তম্ভিত হয়ে বিরাজ করছে কেবল ছিদ্রহীন অন্ধকার ও ভীষণ স্তব্ধতা!
টর্চের আলো ফেলেও বোঝা গেল না, গুহাটা কত বড় এবং তার ভিতরে কী আছে।
বাঘা সেই গুহার ভিতরে ঢুকবার জন্যে বিষম গোলমাল করতে লাগল।
বাঘার রকম দেখে কুমারেরও বুঝতে বাকি রইল না যে, শত্রুরা ওই গুহার ভিতরেই আছে।
এখন কী করা উচিত? গুহার বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেও কোনও লাভ নেই এবং গুহার ভিতরে ঢুকলেও হয়তো কোনও সুবিধাই হবে না–শক্ররা হয়তো তার জন্যেই আনাচে কানাচে গা-ঢাকা দিয়ে আছে, একবার সে ভিতরে গিয়ে ঢুকলেই পোকা-মাকড়ের মতন তাকে টিপে মেরে ফেলবার জন্যে।
কুমার বাঁ-হাতে বাঘার শিকল নিলে। রিভলভারটা খাপ থেকে বার করে একবার পরীক্ষা করে দেখলে। তারপর ডানহাতে টর্চটা নিয়ে গুহার ভিতরে প্রবেশ করলে।
.
আট। গুহার ভিতরে
বাইরের প্রখর আলো ছেড়ে গুহার ভিতরে গিয়ে ঢুকতেই চতুর্দিকব্যাপী প্রচণ্ড ও বিপুল এক অন্ধকারে কুমার প্রথমটা যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেল। তার টর্চের আলো-বাণে বিদ্ধ হয়ে অন্ধকারের অদৃশ্য আত্মা যেন নীরবে আর্তনাদ করে উঠল। সেখানকার অন্ধকার হয়তো জীবনে এই প্রথম আলোকের মুখ দেখলে!
টর্চের আলোক-শিখা ক্রমেই কম-উজ্জ্বল হয়ে দূরে গিয়ে কোথায় হারিয়ে গেল। কুমার বুঝলে, এ-বড় যে-সে গুহা নয়। টর্চে-র মুখ ঘুরিয়ে ডাইনে-বাঁয়েও আলো ফেলে সে পরীক্ষা করে দেখলে, কিন্তু কোনওদিকেই অন্ধকারের থই পাওয়া গেল না।
এত বড় গুহা ও এত জমাট অন্ধকারে ভিতরে কোনওদিকে যে যাওয়া উচিত, সেটা আন্দাজ করতে না পেরে কুমার চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
কিন্তু বাঘার ঘ্রাণ শক্তি তাকে বলে দিলে, শত্রুরা কোনদিকে গেছে! শিকলে টান মেরে সে আবার একদিকে অগ্রসর হতে চাইলে। অগত্যা কুমারকেও আবার বাঘার উপরেই নির্ভর করতে হল।
কিন্তু আগেকার মতো বাঘা এখন আর দ্রুতবেগে অগ্রসর হল না। সে কয়েকপদ এগিয়ে যায়, আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে কান খাড়া করে কি যেন শোনে এবং গরর গরর করে গজরাতে থাকে। যেন সে শত্রুর খোঁজ পেয়েছে।
কিন্তু সেই ভীষণ অন্ধকারের রাজ্যে শত্রুরা যে কোথায় লুকিয়ে আছে, অনেক চেষ্টার পরেও কুমার তা আবিষ্কার করতে পারলে না।
অদ্ভুত সেই অন্ধকার গুহার স্তব্ধতা! বাদুড়ের মতন অন্ধকারের জীবের পাখনাও সেখানে ঝটপট করছে না,–স্থির স্তব্ধতার মধ্যে নিশ্বাস যেন রুদ্ধ হয়ে আসে এবং নিজের পায়ের শব্দে নিজেরই গায়ে কাঁটা দেয়!
কিন্তু বাঘার হাবভাবের অর্থ কুমার ভালোরকমই জানে। যদিও শত্রুর কোনও চিহ্নই তার নজরে ঠেকল না, তবু এটুকু সে বেশ বুঝতে পারলে যে, বাঘা যখন এমন ছটফট করছে। তখন শত্রুরা আর বেশি দূরে নেই; হয়তো কোনও আনাচে কানাচে গা-ঢাকা দিয়ে তারা তার প্রত্যেক গতিবিধিই লক্ষ করছে। কিন্তু একটা বিষয় কুমারের কাছে অত্যন্ত রহস্যের মতো মনে হল। অনেকের মুখেই শত্রুদের যে দানব-মূর্তির বর্ণনা সে শ্রবণ করেছে, এবং তাদের একজনের যে অমানুষিক হাত সে স্বচক্ষে দর্শন করেছে, তাতে তো তাদের কাছে তার ক্ষুদ্র দেহকে নগণ্য বলেই মনে হয়। তার উপরে এই অজানা শত্ৰুপুরীতে সে এখন একা এবং একান্ত অসহায়। যখন তারা দলে ভারী ছিল, শত্রুরা তখনই বিনয়বাবু, রামহরি ও বিমলকে অনায়াসেই হরণ করেছে। এবং এত বড় তাদের বুকের পাটা যে, আধুনিক সভ্যতার লীলাক্ষেত্র দার্জিলিঙে গিয়ে হানা দিতেও তারা ভয় পায় না। কিন্তু তারা এখনও কেন লুকিয়ে আছে,–কেন তাকে আক্রমণ করছে না? এর কারণ কি? কীসের ভয়ে তারা সুমুখে আসতে রাজি নয়?