.
সাত । গুহামুখে
প্রথমটা কুমার বিস্ময়ে এমন হতভম্ব হয়ে পড়ল যে, ঠিক কাঠের পুতুলের মতোই আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মানুষের হাতের মতন দেখতে কোনও হাত যে এত মস্ত হতে পারে, মানুষী স্বপ্নেও বোধহয় তা কল্পনা করা অসম্ভব। একখানা মাত্র হাতের চেটোর ভিতরেই বিমলের গলা ও সমস্ত মুখখানা একেবারে ঢাকা পড়ে গিয়েছে।
তার পরমুহূর্তেই বিমলের দেহ যখন চোখের আড়ালে চলে গেল, তখন কুমারের হুঁশ হল। কিন্তু বৃথা। তখন বিমল বা শত্রুর কোনও চিহ্নই নেই–কেবল ধুপধুপ করে ভারী পায়ের এক বনজঙ্গল ভাঙার শব্দ হল, তারপরেই সব আবার চুপচাপ।
দুই চক্ষে অন্ধকার দেখতে দেখতে কুমার অবশ হয়ে সেইখানে বসে পড়ল। তার প্রাণ মন যেন উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেল খানিকক্ষণ সে কিছুই ভাবতে পারলে না!
অনেকক্ষণ পরে তার মাথা একটু একটু করে পরিষ্কার হয়ে এল।
মৃণু তো সকলের আগেই গিয়েছে, তারপর গেলেন বিনয়বাবু, তারপর রামহরি, তারপর বিমল। বাকি রইল এখন কেবল সে নিজে। কিন্তু তাকেও যে এখন ওই ভয়ংকর অজ্ঞাতের কবলে গিয়ে পড়তে হবে না, তাই-ই বা কে বলতে পারে?
শোকে কুমারের মনটা একবার হু-হু করে উঠল, কিন্তু সে জোর করে নিজের দুর্বলতা দমন করে ফেললে। এরকম অবস্থায় হাত-পা গুটিয়ে অচল হয়ে বসে যারা শোক বা হাহাকার করে, তারা হচ্ছে পঙ্গু বা কাপুরুষ। কুমার কোনওদিন সে দলে ভিড়বে না।
তার আশেপাশে লুকিয়ে আছে যে-সব জীব, তাদের অমানুষিক কণ্ঠের চিৎকার সে শুনেছে, তাদের বিরাট পায়ের দাগও সে মাটির উপরে দেখেছে এবং তাদের একজনের অভাবিত একখানা হাতও এইমাত্র তার চোখের সুমুখ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। কুমার বেশ। ভালো করেই বুঝতে পারলে যে, যাদের হাত-পা ও কণ্ঠস্বর এমনধারা, তাদের সামনে একাকী গিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টাটা হবে কালবোশেখি ঝড়ের বিরুদ্ধে একটা মাছির তুচ্ছ চেষ্টার মতোই হাস্যকর! এমন অবস্থায় কোনও সাহসী ও বলিষ্ঠ লোকও যদি প্রাণ হাতে করে ফিরে আসে, তাহলে কেউ তাকে কাপুরুষ বলতে পারবে না।–একথাটাও তার মনে হল। কিন্তু তখনই সে-কথা ভুলে কুমার নিজের মনে-মনেই বললে, মানুষের কাছে একটা খুদে লাল পিঁপড়ে কতটা নগণ্য! মানুষের একটা নিশ্বাসে সে উড়ে যায়! কিন্তু মানুষ যদি সেই তুচ্ছ লাল পিঁপড়ের গায়ে হাত দেয়, তাহলে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সে মানুষকে আক্রমণ করতে একটুও ভয় পায় না। আমিও ওই লাল পিঁপড়ের মতোই হতে চাই। বিমল যদি মারা পড়ে থাকে, তাহলে যে পৃথিবীতে বিমল নেই, আমিও সেখানে বেঁচে থাকতে চাই না! যে-পথে বিনয়বাবু গেছেন, রামহরি গেছে, বিমল গেছে, আমিও যাব সে-পথে। যদি প্রতিশোধ নিতে পারি, প্রতিশোধ নেব। যদি মৃত্যু আসে, মৃত্যুকে বরণ করব। কুমার উঠে দাঁড়াল।
বাঘাকে ধরে রাখা দায়! উপরকার পাহাড়ের যেখানে খানিক আগে শত্রু-হস্ত আবির্ভূত হয়েছিল, বিষম গর্জন করতে করতে বাঘা এখন সেইখানেই যেতে চায়! বারংবার হুমকি দিয়ে সে সমানের দিকে ঝুঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু তারপরেই শিকলে বাধা পেয়ে পিছনের দু-পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে সুমুখের দু-পায়ে যেন মহা আক্রোশে শূন্যকেই আঁচড়াতে থাকে কুমারের হাত থেকে শিকল খসে পড়ে আর কি!
কিন্তু কুমার শিকলটাকে হাতে পাকিয়ে ভালো করে ধরে রইল–সে বুঝলে, এই ভয়াবহ দেশে একবার হাতছাড়া হলে বাঘাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখন বাঘাই তার একমাত্র সঙ্গীতার কাছ থেকে সে অনেক সাহায্যই প্রত্যাশা করে! এ-পথে এখন বাঘা তার শেষ বন্ধু!
পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে কুমার উপরে উঠতে লাগল। খানিক পরেই বিমল যেখান থেকে অদৃশ্য হয়েছিল, সেইখানে গিয়ে উপস্থিত হল। কিন্তু সেখানে শত্রু বা মিত্র কারুর কোনও চিহ্নই নেই।
কুমার পায়ের তলায় পাহাড়ের গা তীক্ষ্ণ নেত্রে পরীক্ষা করে দেখলে। কিন্তু রক্তের দাগ না দেখে কতকটা আশ্বস্ত হল।
সে এখন কী করবে? কোনদিকে যাবে? এখানে তো পথের বা বিপথের কোনও চিহ্নই নেই। যতদূর চোখ যায়, গাছপালা জঙ্গল নিয়ে পাহাড়ের ঢালু গা ক্রমেই উপরের দিকে উঠে গিয়েছে।
কিন্তু কুমারকে কোনদিকে যেতে হবে, বাঘাই আবার তা জানিয়ে দিলে। এদিকে-ওদিকে মুখ ফিরিয়ে বাঘা যে কীসের গন্ধ পেলে তা কেবল বাঘাই জানে, কিন্তু তারপরেই মাটির উপরে মুখ নামিয়ে তাড়াতাড়ি সে আবার এগিয়ে চলল। একটুপরেই ঘন জঙ্গল তাদের যেন গিলে ফেললে!
অল্পদুর অগ্রসর হয়েই জঙ্গলের ভিতরে আবার একটা পায়েচলা পথ পাওয়া গেল। সে পথের উপরে বড় বড় গাছের ছায়া এবং দু-ধারে ঝোপঝাঁপ আছে বটে, কিন্তু পথটা যেখান দিয়ে গেছে, সেখান থেকে ঝোপঝাঁপ কারা যেন যতটা সম্ভব সাফ করে রেখেছে।
এইভাবে বাঘার সঙ্গে কুমার প্রায় ঘণ্টা-তিনেক পথ দিয়ে ক্রমাগত উপরে উঠতে লাগল। কিন্তু সারাপথে কেবল দু-চারটে বুনো কুকুর ছাড়া আর কোনও প্রাণীর সাক্ষাৎ পেলে না। শত্রুরা এখনও লুকিয়ে তার উপর নজর রেখেছে কি না, সেটাও বুঝতে পারলে না। বিপুল পরিশ্রমে। তার শরীর তখন নেতিয়ে পড়েছে এবং এমন হাঁপ ধরেছে যে, খানিকক্ষণ না জিরিয়ে নিলে আর চলা অসম্ভব।
পথটা তখন একেবারে পাহাড়ের ধারে এসে পড়েছে, সেখান থেকে নীচের দিকটা দেখাচ্ছে ছবির মতো।