কুমার ত্রস্ত স্বরে বললে, বাঘা তো নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোচ্ছিল। আমি তাকে একটা গাছের গোড়ায় বেঁধে এসেছি। হঠাৎ কি দেখে সে চাঁচালে?
দুজনে ত্রস্তপদে ফিরে এসে দেখলে, বাঘা ক্রমাগত চিৎকার করছে এবং শিকলি-বাঁধা অবস্থায় মাঝে মাঝে পিছনের দু-পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠছে!
বিমল বললে, রামহরিও তো এইখানেই শুয়েছিল। রামহরি কোথায় গেল? রামহরি!..রামহরি!…রামহরি!
কিন্তু রামহরির কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। কুমার ভয়ার্ত কণ্ঠে বললে, তবে কি তারা রামহরিকেও চুরি করে নিয়ে গেল?
বিমল বললে, কুমার। বাঘাকে এগিয়ে দাও! শত্ৰু কোনদিকে গেছে, বাঘা তা জানে।
কুমার ও বিমলের আগে আগে বাঘা আবার এগিয়ে চলল, মাটির উপরে নাক রেখে।
কুমার বললে, বিমল, যে শত্রুদের পাল্লায় আমরা পড়েছি, তাদের তুমি মানুষের চেয়ে তুচ্ছ মনে কোরো না। দেখো, এরা প্রায় আমাদের সুমুখে থেকেই উপরি-উপরি বিনয়বাবু আর রামহরিকে ধরে নিয়ে গেল, অথচ আমরা কিছুই জানতে পারলুম না। আমরা কি করছি না। করছি সমস্তই ওরা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ করছে, অথচ আমরা তাদের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছি অসহায় অন্ধের মতো। এইবারে আমাদের পালা বিমল, এইবারে আমাদের পালা।
দাঁতে দাঁত চেপে বিমল বললে, দেখা যাক!
তারা একটি ছোট নদীর ধারে এসে পড়ল, শিশুর মতো নাচতে নাচতে পাহাড়ের ঢালু গা বয়ে স্বচ্ছ জলের ধারা তরতর করে বয়ে যাচ্ছে!
নদীর ধারে এসে বাঘা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর ব্যস্তভাবে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল–যেন সে বলতে চায়, শত্রুর পায়ের গন্ধ জলে ডুবে গেছে, এখন আমায় আর কী করতে হবে বলো?
বিমল বললে, আমরা রঙ্গু নদীর তীরে এসে পড়েছি। এটা রঙ্গিত নদীর একটি শাখা।
কুমার বললে, এ জায়গাটা দার্জিলিং থেকে কত দূরে?
বিমল বললে, এখান থেকে দার্জিলিং এগারো-বারো মাইলের কম হবে না। আরও কিছুদূর এগুলেই আমরা সিকিম রাজ্যের সীমানায় গিয়ে পড়ব।
কুমার বললে, এখন আমাদের উপায়? বাঘা তো শত্রুদের পায়ের গন্ধ হারিয়ে ফেলেছে। এখন আমরা কোনদিকে যাব?
বিমল বললে, পায়ের গন্ধ বাঘা এই নদীর ধারে এসেই হারিয়ে ফেলেছে। এই দেখ শত্রুদের পদচিহ্ন। তারা নদীর ওপারে গিয়ে উঠেছে। এই তো এতটুকু নদী, আমরা অনায়াসে ওপারে যেতে পারব। বলেই বিমল জলে নেমে পড়ল, তার সঙ্গে সঙ্গে নামল বাঘাকে নিয়ে। কুমারও।
নদীর ওপারে উঠেই মাটির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বিমল বললে, এই দেখো, আবার সেই অমানুষিক পায়ের চিহ্ন।
বাঘাও তখনি হারিয়ে যাওয়া গন্ধ আবার খুঁজে পেলে। গা থেকে জল ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে আবার সে ছুটে চলল।
কিন্তু বিমল তার শিকল চেপে ধরে বললে, বাঘা, দাঁড়া!..কুমার! এখনও আমাদের কত দুরে কতক্ষণ যেতে হবে, কে তা জানে? পথে হয়তো জলও পাওয়া যাবে না। তাড়াতাড়ি এখানে বসে মুখে কিছু দিয়ে জল পান করে ফ্লাস্কে জল ভরে নিয়ে তারপর আবার শত্রুদের পিছনে ছুটব! কি বলো?
কুমার বললে, খেতে এখন আমার রুচি হচ্ছে না!
বিমল বললে, খাবার ইচ্ছে আমারও নেই, কিন্তু শরীরের ওপর যে অত্যাচারটা হচ্ছে, না খেলে একটু পরেই সে যে ভেঙে পড়বে। খানকয় স্যান্ড উইচ আছে, টপটপ করে খেয়ে ফেলো। এই নে বাঘা, তুইও নে।
আবার তারা এগিয়ে চলল–সর্বাগ্রে বাঘা, তারপর কুমার, তারপর বিমল।
খানিক পরে তারা পাহাড়ের যে অংশে এসে পড়ল, সেদিক দিয়ে মানুষের আনাগোনা করার কোনও চিহ্ন নেই। অন্তত মানুষের আনাগোনা করার কোনও চিহ্ন তাদের নজরে ঠেকল না। যদিও কোথাও মানুষের সাড়া বা চিহ্ন নেই, তবুও বনের ভিতর দিয়ে পথের মতন একটা কিছু রয়েছে বলেই তারা এখনও অগ্রসর হতে পারছিল। এখান দিয়ে চলতে-চলতে যদিও বেত ও নানা কাটাগাছ দেহকে জড়িয়ে ধরে, ঝুলেপড়া গাছের ডালে মাথা ঠুকে যায়, ছোট-বড় পাথরে প্রায় হোঁচট খেতে হয় এবং ঘাসের ভিতর থেকে বড় বড় জোঁক বেরিয়ে পা কামড়ে ধরে, অগ্রসর হওয়ার পক্ষে এসবের চেয়ে বড় আর কোনও বাধা নেই। মাঝে মাঝে এক-একটা বড় গাছ বা ঝোপ উপড়ে বা ভেঙে ফেলে কারা যেন আনাগোনার জন্য পথ সাফ করে রেখেছে। এমনভাবে বড় বড় গাছগুলোকে উপড়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে যে, দেখলেই বোঝা যায়, তা। মানুষের কাজ নয়। যে-সব অরণ্যে হাতির পাল চলাফেরা করে, সেইখানেই এমনভাবে ভাঙা বা উপড়ানো গাছ দেখা যায়। এখানে হাতিও নেই, মানুষও নেই,তবুও পথ চলবার বাধা সরিয়ে রেখেছে কারা?
এই প্রশ্ন মনে জাগতেই কুমারের বুকটা যেন শিউরে উঠল!
বেচারা রামহরি! তার সাহস ও শক্তির অভাব নেই, মূর্তিমান মৃত্যুর সামনেও সে কতবার হাসিমুখে ছুটে গিয়েছে। কিন্তু এক ভূতের ভয়েই সর্বদা সে কাতর হয়ে পড়ে। কিন্তু তার অদ্ভুত প্রভুভক্তি এই ভূতের ভয়কেও মানে না, তাই এত বড় বিপদের মাঝখানেও সে তাদের ছেড়ে থাকতে পারেনি। কিন্তু এখন? এখন সে কোথায়? সে বেঁচে আছে কি না কে জানে।
একটা পাহাড়ের খানিকটা যেখানে পথের উপর ঝুঁকে আছে, সেইখানে বাঘা হঠাৎ ডানদিকে মোড় ফিরলে।
কুমারও সেইদিকে ফিরলে এবং সঙ্গে সঙ্গে পিছনদিকে কি একটা শব্দ শুনেই চমকে উঠে আবার ফিরে দাঁড়াল এবং তারপর সে কী দৃশ্যই দেখল!
ঝুঁকে পড়া পাহাড়ের উপর থেকে প্রকাণ্ড অজগর সাপের মতো মোটা এবং কালো রোমশ একখানা হাত বিমলের মুখ ও গলা একসঙ্গে চেপে ধরে তার দেহকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।