.
ছয় । অজগরের মতন হাত
তোমাদের মধ্যে যারা কলকাতায় থাকো, তারা জানো বোধ হয়, নিউ ইয়াস ডের রাত্রি দুপুরের সময় গঙ্গানদীর স্টিমারগুলো একসঙ্গে এমন ভে দিয়ে ওঠে যে, কান যেন ফেটে যায়।
হিমালয়ের পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে এই ভীষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রে বিমল, কুমার ও রামহরির চারিদিক থেকে এখন অনেকটা তেমনিধারা বিকট চিৎকারই জেগে উঠেছে। তবে স্টিমারের ভো-দেওয়ার ভিতরে ভয়ের ব্যাপার কিছু নেই, কিন্তু এখানকার এই অস্বাভাবিক কোলাহলে অবর্ণনীয় আতঙ্কে ও যন্ত্রণায় সকলের প্রাণ যেন ছটফট করতে লাগল।
আর,–এ চিৎকার কোনও যন্ত্রের চিৎকার নয়, এ ভয়াবহ চিৎকারগুলো বেরিয়ে আসছে অজানা ও অদৃশ্য সব অতিকায় জীবের কণ্ঠ থেকেই! দুশো-আড়াইশো সিংহ একসঙ্গে গর্জন। করলেও তা এতটা ভয়ঙ্কর বলে মনে হত না!
প্রথমটা সকলেই কী করবে ভেবে না পেয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চারিদিক থেকেই সেই বিকট চিৎকার উঠছে, কাজেই কোনওদিকেই পালাবার উপায় নেই!
কুমারের মনে হল, তাদের দিকে ক্রুদ্ধ অগ্নিময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে করতে দৈত্য দানবের মতো কারা যেন চাঁচাতে চাঁচাতে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। এগিয়ে আসছে– ক্রমেই এগিয়ে আসছে তাদের কবল থেকে মুক্তিলাভের আর কোনও উপায় নাই।
হঠাৎ বিমল বলে উঠল, কুমার উঠে দাঁড়াও। হাত-পা গুটিয়ে চুপ করে থাকবার সময় নয়। বন্দুক ছোঁড়ো, যা থাকে কপালে!
বিমল ও কুমার লক্ষ্যহীন ভাবেই অন্ধকারের ভিতর গুলির পর গুলি চালাতে লাগল, তাদের দেখাদেখি রামহরিও সব ভয় ভুলে বন্দুক ছুঁড়তে কসুর করলে না।
শত্রুদের বিকট চিল্কারের সঙ্গে তিন-তিনটে বন্দুকের গর্জন মিলে চারিদিকটা যেন শব্দময় নরক করে তুললে–কাজেই বন্দুকের গুলিতে আহত হয়ে কেউ আর্তনাদ করলে কি না, সেটা কিছুই বোঝা গেল না, কিন্তু দু-এক মিনিটের মধ্যেই সমস্ত গোলমাল একেবারে থেমে গেল।
অন্ধকারের ভিতরে আরও কয়েকটা গুলি চালিয়ে বিমল বললে, আমাদের ভয় দেখাতে এসে হতভাগারা এইভাবে নিজেরাই ভয়ে পালিয়েছে। বন্দুকের এমনি মহিমা!
কুমার বললে, মিছেই তারা ভয় পেয়ে পালিয়েছে। লোকে যা বলে, তাদের চেহারা যদি সেই রকমই হয়, তাহলে তাদের ভয় পাওয়ার কোনওই কারণ ছিল না। তারা দল বেঁধে আক্রমণ করলে আমাদের বন্দুক কিছুই করতে পারত না।
বিমল বললে, কুমার, কেবল মস্তিষ্কের জোরেই মানুষ আজ জীবরাজ্যে প্রধান হয়ে উঠেছে। আদিমকালে পৃথিবীতে যারা প্রভুত্ব করত, সেইসব ডাইনসরের তুলনায় মানুষ কত তুচ্ছ! তাদের নিশ্বাসেই বোধ হয় মানুষ পোকা-মাকড়ের মতো উড়ে যেত। কিন্তু তবু তারা দুনিয়ায় টিকে থাকতে পারেনি। একালের হাতি, গন্ডার, হিপো, সিংহ, ব্যাঘ্র–এমনকী, ঘোড়া-মোষ-গরু পর্যন্ত গায়ের জোরে মানুষের চেয়ে ঢের বড়। কিন্তু তবু তারা মানুষকে ভয় করে এবং গোলামের মতো মানুষের সেবা করে। গায়ের জোরের অভাব মানুষ তার মস্তিষ্কের দ্বারা পূরণ করে নিয়েছে। আমাদের হাতে যে বন্দুকগুলো আছে, আর আমাদের ব্যাগে যে বোমাগুলো আছে এগুলো দান করেছে মানুষের মস্তিষ্কই। আজ যে-সব জীবের পাল্লায় আমরা পড়েছিলুম, তারা যত ভয়ানকই হোক, সভ্য মানুষের মস্তিষ্ক তাদের মাথায় নেই। তারা আমাদের ভয় করতে বাধ্য।
রামহরি বিরক্ত স্বরে বলল, খোকাবাবু বোমা-টোমা তুমি আবার সঙ্গে করে এনেছ কেন? শেষকালে কি পুলিশের হাতে পড়বে?
কুমার হেসে বললে, ভয় নেই রামহরি, তোমার কোনও ভয় নেই। দুষ্ট রাজবিদ্রোহীদের মতো আমরা যে মানুষ মারবার জন্যে বোমা ছুড়ব না, পুলিশ তা জানে। পুলিশকে লুকিয়ে আমরা বোমা আনিনি–আমরা পুলিশের অনুমতি নিয়েই এসেছি!
বিমল বললে, পূর্বদিকে একটু একটু করে আলো ফুটছে, ভোর হতে আর দেরি নেই। সকাল পর্যন্ত বিশ্রাম করে, তারপর আবার যাত্রা শুরু করা যাবে।
কুমার বললে, বিমল, শুনতে পাচ্ছ? কাছেই কোথায় জলের শব্দ হচ্ছে!
বিমল বললে, হুঁ! বোধ হয় আমরা রঙ্গু নদীর তীরে এসে পড়েছি। এখন সে-সব ভাবনা ভুলে ঘণ্টাখানেকের জন্যে চোখ মুদে নাও। বাঘা ঠিক পাহারা দেবে।
.
সকালের আলোয় সকলের ঘুম ভেঙে গেল।
বিমল উঠে বসে চেয়ে দেখলে, তার চারিদিকে শাল ও দেবদারু এবং আরও অনেক রকম গাছের ভিড়। গাছের তলায় তলায় লতা-গুল্ম ভরা ঝোপঝাঁপ। নীল আকাশ দিয়ে সোনার জলের মতো সূর্যের আলো ঝরে পড়ছে। মিষ্টি বাতাসে পাখনা কাঁপয়ে প্রজাপতিরা আনাগোনা করছে রংবেরঙের ফুলের টুকরোর মতো! দার্জিলিংয়ের চেয়ে এখানকার হাওয়া অনেকটা গরম।
কালকের নিবিড় অন্ধকারে যে-স্থানটা অত্যন্ত ভীষণ বলে মনে হচ্ছিল, আজকের ভোরের আলো তাকেই যেন পরম শান্তিপূর্ণ করে তুলেছে।
বিমল ও কুমার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চারিদিক পরীক্ষা করতে করতে এগিয়ে গেল। স্থানে স্থানে লতাগুল্ম ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে–যেন তাদের উপর দিয়ে খুব ভারী কোনও জীব চলে গিয়েছে। এক জায়গায় অনেকখানি পুরু রক্ত জমাট বেঁধে আছে।
কুমার বললে, বিমল, আমাদের বন্দুক ছোঁড়া তাহলে একেবারে ব্যর্থ হয়নি! দেখো, দেখো, এখানে রক্তমাখা সেইরকম মস্ত মস্ত পায়ের দাগও রয়েছে যে! দাগগুলো সামনে জঙ্গলের ভিতরে চলে গিয়েছে।
আচম্বিতে পিছন থেকে শোনা গেল, বাঘার বিষম চিৎকার!