খালি মুখ?
হ্যাঁ, খালি মুখতার আর কিছু আমি দেখতে পাইনি। ঝকড়া আঁকড়া চুল আর আমার এই হাতের চেটোর মতো বড় বড় আগুন-ভরা চোখ,বাপরে, ভাবতেও আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
কুমার বললে, কিন্তু সে মুখের কথা এখন থাক! বিমল, বিনয়বাবু কোথায় গেলেন?
আমিও সেই কথাই ভাবছি। তার চিৎকার আমরা সকলেই শুনেছি, তাঁর বন্দুকটাও এখানে পড়ে রয়েছে, কিন্তু তিনি গেলেন কোথায়?
হঠাৎ খানিক তফাতে জঙ্গলের মধ্যে এক অদ্ভুত শব্দ উঠল–যেন বিরাট একটা রেল ইঞ্জিনের মতন অসম্ভব দেহ জঙ্গলের গাছপালা ভাঙতে ভাঙতে বেগে এগিয়ে চলে গেল! সঙ্গে সঙ্গে বাঘার ঘেউঘেউ-ঘেউ! এবং রামহরির আর্তনাদ–ওই শোনো খোকাবাবু, ওই শোনো!
গাছপালার মড়মড়ানি ও ভারী ভারী পায়ের ধুপধুপুনি শব্দ ক্রমেই দূরে চলে যেতে লাগল। বিমল বললে, এখানে যে ছিল, সে চলে গেল!
কুমার বললে, কিন্তু বিনয়বাবুর কোনও সন্ধানই তো পাওয়া গেল না।
কুমারের কথা শেষ হতে না হতেই অনেকদূর থেকে শোনা গেল বিমল! বিমল! কুমার! রক্ষা করো রক্ষা করো! বিমল! বি– হঠাৎ আর্তনাদটা আবার থেমে গেল।
কুমার বললে, বিমল–বিমল! ওই তো বিনয়বাবুর গলা!
বিমল বললে, কুমার, বিনয়বাবু নিশ্চয়ই দানবের হাতে বন্দি হয়েছেন। তারা নিশ্চয়ই তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
এখন কি হবে বিমল, আমরা কী করব?
আমরা?..আমরা শত্রুর পিছনে পিছনে যাব–বিনয়বাবুকে উদ্ধার করব!
কিন্তু কোনদিকে যাব? পৃথিবীতে এক ফোঁটা আলো নেই, আকাশ যেন অন্ধকার বৃষ্টি করছে! কে আমাদের পথ দেখাবে?
বাঘা। শত্রুর পায়ের গন্ধ সে ঠিক চিনতে পারবে বাঘা যে শিক্ষিত কুকুর! তুমিও ওর গলায় শিকল বেঁধে ওকে আগে আগে যেতে দাও, আমরা ওর পিছনে থাকব। রামহরি, তুমি কি আমাদের সঙ্গে আসবে, না বাসায় ফিরে যাবে?
রামহরি বললে, তোমরা যেখানে থাকবে, সেই তো আমার বাসা! তোমাদের সঙ্গে ভূতের বাড়ি কেন, যমের বাড়ি যেতেও আমি নারাজ নই।
হ্যাঁ রামহরি, হয়তো আজ আমরা যমের বাড়ির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। মন্দ কি, পারি তো যমের একখানা ফোটো তুলে নিয়ে আসব।
রামহরি গজগজ করে বললে, যত সব অনাছিষ্ট কথা!
বিমলের কথা মিথ্যা নয়। বাঘার নাকই অন্ধকারে তাদের চোখের কাজ করলে। বাঘা কোনওদিকে ফিরে তাকালে না, মাটির উপরে নাক রেখে সে বেগে অগ্রসর হতে লাগল। কুমার তার গলার শিকলটা না ধরে রাখলে এতক্ষণে সে হয়তো আরও বেগে তিরের মতো ছুটে নাগালের বাইরে কোথায় চলে যেত!
তিনজনে বাঘার পিছনে পিছনে অতি কষ্টে পথ চলতে লাগল।
কুমার বললে, বনের ভেতরে রামহরি যাকে দেখেছে, তার বর্ণনা শুনে মনে হল সে এক সাংঘাতিক জীব!
রামহরি শিউরে উঠে বললে, তার কথা আর মনে করিয়ে দিও না বাবু, তাহলে হয়তো আমি ভিরমি যাব! উঃ, মুখখানা মানুষের মতো দেখতে বটে, কিন্তু হাতির মুখের চেয়েও বড়!
অমন ভয়ানক যার মুখ, আমাদের দেখেও সে আক্রমণ করলে না কেন?
বিমল বললে, হয়তো আমাদের হাতের ইলেকট্রিক টর্চ দেখে সে ভড়কে গেছে।
কুমার বললে, আশ্চর্য নয়। মোটরের হেড-লাইট দেখে অনেক সময়ে বাঘ-ভল্লুকও হতভম্ব হয়ে যায়!
আবার তারা নীরবে অগ্রসর হতে লাগল।
.
এইভাবে ঘণ্টা-তিনেক দ্রুতপদে এগিয়ে তারা যে কোথায়, কোনদিকে, কতদূরে এসে পড়ল, কেউ তা বুঝতে পারলে না। এবং এইভাবে আর বেশিক্ষণ বাঘার সঙ্গে চলা যে তাদের পক্ষে অসম্ভব, এটুকু বুঝতেও তাদের বাকি রইল না। এরই মধ্যে বারবার হোঁচট খেয়ে পাথরের উপরে পড়ে তাদের সর্বাঙ্গ থেঁতো হয়ে গেছে, গায়ের কত জায়গায় কত কাটা বিঁধেছে, ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে জামা কাপড়ের আর পদার্থ নেই! তাদের ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস পড়ছে, দম বুঝি। আর থাকে না!
এইবারে তারা একটা বড় জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করল। সকলে হাঁপাতে হাঁপাতে কোনওগতিকে আরও কিছুদূর অগ্রসর হল। তারপর রামহরি বললে, খোকাবাবু, আমি তো তোমাদের মতন জোয়ান ছোকরা নই, আমাকে একটু হাঁপ ছাড়তে দাও!
বিমল বললে, রামহরি, কেবল তোমারই নয়, আমারও বিশ্রাম দরকার হয়েছে, আমিও এই বসে পড়লুম।
কুমারের অবস্থাও ভালো নয়, সেও অবশ হয়ে ধুপ করে বসে পড়ল।
কিন্তু বাহাদুর বটে বাঘা! যদিও দারুণ পরিশ্রমে তার জিব মুখের বাইরে বেরিয়ে পড়ে লকলক করে ঝুলছে, তবু এখনও তার এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ একটুও কমেনি।
কুমার চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে বললে, মনে হচ্ছে, আজকের এই অন্ধকারের অন্ধতা কখনও দূর হবে না, আজকের এই অনন্ত রাতের বিভীষিকা কখনও শেষ হবে না।
রামহরি বললে, একটা জানোয়ারের বুদ্ধি মানুষের চেয়ে বড় হয় রামহরি। ভগবান মানুষকে বঞ্চিত করে এমন কোনও কোনও শক্তি পশুকে দিয়েছেন, যা পেলে মানুষের অনেক উপকারই হত!
আচম্বিতে সেই বোবা অন্ধকার, কালো রাত্রি এবং স্তব্ধ অরণ্য যেন ভীষণ ভাবে জ্যান্ত হয়ে উঠল।–ও কী খোকাবাবু, ও কী বলতে, বলতে রামহরি আঁতকে দাঁড়িয়ে উঠল।
বাঘা চেঁচিয়ে এবং চমকে চমকে উঠে শিকল ছিঁড়ে ফেলে আর কি!
বিমল ও কুমার সন্ত্রস্ত হয়ে শুনতে লাগল–তাদের সামনে, পিছনে, ডানপাশে, বামপাশে, কাছে, দুরে চারিদিক থেকে যেন চল্লিশ-পঞ্চাশখানা বড় বড় স্টিমার কান ফাটিয়ে প্রাণ দমিয়ে ক্রমাগত কু দিচ্ছে–যেন বনবাসী অন্ধকারের চিৎকার, যেন সদ্যজাগ্রত অরণ্যের হুঙ্কার, যেন বিশ্বব্যাপী ভূত-প্রেতের গর্জন!