বিমলের মনে হতে লাগল, এই অন্ধকারে পাহারা দিয়ে কোনওই লাভ নেই! যদি এরই ভিতর দিয়ে কোনও ভীষণ মূর্তি নিঃশব্দে পা ফেলে চলে যায়, তবে কোনও মানুষের চক্ষুই তা দেখতে পাবে না।
.
নিশুত রাতের বুক যেন ধুকপুক করছে। বরফ-মাথা কনকনে হাওয়া যেন মৃতদেহের মতো ঠান্ডা। দূর থেকে ভুটিয়াদের বৌদ্ধ মন্দিরের ঘণ্টার আওয়াজ শোনা গেল–এ পবিত্র ঘণ্টা বাজে দুষ্ট প্রেতাত্মাদের তাড়াবার জন্যে। কিন্তু পাহাড়ে রাতের প্রেতাত্মারা ঘণ্টাধ্বনি শুনলে সত্যই কি পালিয়ে যায়? তবে আচম্বিতে ওখানে অমন অপার্থিব ধ্বনি জাগছে কেন?…না, এ হচ্ছে গাছের পাতার বাতাসের আর্তনাদ। রাতের আত্মা কি কাঁদছে? রাতের প্রাণ কি ছটফট করছে? রাত্রি কি আত্মহত্যা করতে চাইছে?
এমনি সব অসম্ভব পাগলামি নিয়ে বিমলের মন যখন ব্যস্ত হয়ে আছে, তখন অকস্মাৎ বাঘা ধড়মড়িয়ে দাঁড়িয়ে রেগে গরর গরর করে উঠল।
বিমলও তৎক্ষণাৎ চাঙ্গা হয়ে উঠল, চারিদিকে তীব্র ও তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করলে, কিন্তু চোখে কিছু দেখতে পেলে না,–চতুর্দিকে যে অন্ধকার সেই অন্ধকারই! বাঘার গলায় হাত রেখে সে বললে, কিরে বাঘা, চাঁচালি কেন? আমার মতন তুইও কি দুঃস্বপ্ন দেখছিস?
বিমলের মুখের কথা ফুরোতে না ফুরোতেই সেই স্তব্ধ রাত্রির বক্ষ বিদীর্ণ করে কে অতি যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠল, বিমল! কুমার! রক্ষা করো! রক্ষা করো!
বিমলের বুক স্তম্ভিত হয়ে গেল,–এ যে বিনয়বাবুর কণ্ঠস্বর!
.
পাঁচ। অরণ্যের রহস্য
বিনয়বাবুর গলার আওয়াজ! কী ভয়ানক বিপদে পড়ে এত যন্ত্রণায় তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন? কিন্তু কালো রাত আবার স্তব্ধ হয়ে পড়ল, বিনয়বাবু আর চিৎকার করলেন না।
লুকানো জায়গা থেকে বিমল একলাফে বেরিয়ে এল–বাঘা তার আগেই দৌড়ে এগিয়ে গিয়েছে। অন্যদিক থেকে দ্রুত পায়ের শব্দ শুনে বিমল বুঝলে, কুমার আর রামহরিও ছুটে আসছে।
কিন্তু কোনদিকে যেতে হবে? এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কোলের মানুষ চেনা যায় না, বিপদের আবির্ভাব হয়েছে যে ঠিক কোন জায়গায়, তা স্থির করা এখন অসম্ভব বললেই চলে।
বিমল তখন বাঘার পশুশক্তির উপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে রইল। সে বুঝলে, পশু বাঘার যে শক্তি আছে, মানুষের তা নেই। পশুর চোখ অন্ধকারে মানুষের চেয়ে তীক্ষ্ণ তো বটেই, তার উপরে ঘ্রাণশক্তি তাকে ঠিক পথেই চালনা করে।
রামহরি বিজলী-মশাল জ্বালতেই বিমল বাধা দিয়ে বললে, না, না, এখন আলো জ্বেলো না, শত্রু কোনওদিকে তা জানি না, এখন আলো জ্বাললে আমরাই ধরা পড়ে মরব!
তীব্র দৃষ্টিতে অন্ধকারের রহস্যের ভিতরে তাকিয়ে তারা তিনজনে অত্যন্ত সজাগ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল–তাদের কাছে এখন প্রত্যেক সেকেন্ড যেন এক এক ঘণ্টার মতন দীর্ঘ বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না–মিনিটখানেক পরেই হঠাৎ বাঘার ঘন ঘন গর্জনে নীরব কালো রাতের ঘুম আবার ভেঙে গেল।
বিমল উত্তেজিত স্বরে বললে, বাঘা খোঁজ পেয়েছে। ওইদিকে–ওইদিকে! রামহরি, টর্চ জ্বেলে আগে আগে চলো। কুমার, আমার সঙ্গে এসো!
রামহরির পিছনে পিছনে বিমল ও কুমার বন্দুক বাগিয়ে ধরে দ্রুতপদে এগিয়ে চলল। একটা ঝোপের সামনে দাঁড়িয়ে বাঘা ক্রমাগত চিৎকার করছে। সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখা গেল, ঝোপের পাশেই একটা বন্দুক পড়ে রয়েছে।
কুমার বললে, বিনয়বাবুর বন্দুক। কিন্তু বিনয়বাবু কোথায়?
রামহরি তাড়াতাড়ি আলো নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে ঢুকল এবং পরমুহূর্তেই আকুল স্বরে চেঁচিয়ে উঠল–ভূত। খোকাবাবু!
আচম্বিতে এই অপ্রত্যাশিত চিৎকার বিমল ও কুমারকে যেন আচ্ছন্ন করে দিলে। কিন্তু তারপরেই নিজেদের সামলে নিয়ে বিজলি মশাল জ্বেলে তারাও এক এক লাফে জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে পড়ল।
দুই হাতে মুখ চেপে রামহরি মাটির উপরে হাঁটু গেড়ে বসে আছে।
বাঘা ছুটে জঙ্গলের আরও ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিল, কিন্তু কুমার টপ করে তার গলার বগলস চেপে ধরলে। বাঘা তবু বশ মানলে না, ছাড়ান পাওয়ার জন্যে পাগলের মতন ধস্তাধস্তি করতে লাগল।
বিমল চারিদিকে তাকিয়ে দেখলে, কিন্তু বিনয়বাবুর কোনও চিহ্ন বা ভয়-পাওয়ার মতো অন্য কিছুই তার নজরে ঠেকল না।
কুমার বললে, রামহরি! কী হয়েছে তোমার? কী দেখেছ তুমি?
রামহরি ফ্যালফ্যালে চোখে বোবার মতো একবার কুমারের মুখের পানে চাইলে এবং তারপরে জঙ্গলের একদিকে আঙুল তুলে দেখালে। তখনও সে ঠকঠক করে কাঁপছিল।
বিমল বললে, অমন ক্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে আছ কেন? ওখানে কী আছে?
রামহরি খালি বললে, ভূত!
ভূত! তোমার ভূতের নিকুচি করেছে। দাঁড়াও, আমি দেখে আসছি–এই বলে বিমল সেইদিকে অগ্রসর হওয়ার উপক্রম করলে।
রামহরি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না, না! খোকাবাবু, তোমার পায়ে পড়ি, তুমি ওদিকে যেয়ো না!
কেন? ওদিকে কী আছে!
ভূত! রাক্ষস! দৈত্য কি দানব। যাকে দেখেছি সে যে কে, তা আমি জানি না– কিন্তু সে মানুষ নয়, খোকাবাবু, মানুষ নয়।
বিমল খুব বিরক্ত হয়ে বললে, আর তোমার পাগলামি ভালো লাগে না রামহরি। হয় যা দেখেছ স্পষ্ট করে বলো, নয়, এখান থেকে বিদেয় হও।
রামহরি বললে, সত্যি বলছি খোকাবাবু, আমার কথায় বিশ্বাস করো। যেই আমি জঙ্গলের ভেতর এলুম, অমনি দেখলুম, জয়ঢাকের চেয়েও একখানা ভয়ানক মুখ সাঁৎ করে ঝোপের আড়ালে সরে গেল।