কুমার বললে, আমরা তো দূরে কোথাও যাচ্ছি না, তবে মিছিমিছি এমন মোট বয়ে লাভ কি?
বিমল বললে, কুমার, তুমিও বোকার মতন কথা কইতে শুরু করলে? ..মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার এক মিনিট আগেও আমরা কি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিলুম, কোথায় কোথায় যেতে হবে? প্রতি মুহূর্তে যাদের মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করতে হয়, তাদের কি অসাবধানতার নিশ্চিন্ত আনন্দ ভোগ করবার সময় আছে?
কুমার কোনও জবাব দিতে পারলে না, লজ্জিত হয়ে চলে গেল। এমন সময় বিনয়বাবু ঘরের ভিতর প্রবেশ করলেন। তাঁর মুখ দেখেই বোঝা যায়, তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়েছেন।
বিমল কিছু বললে না, বিনয়বাবু কি বলেন তা শোনবার জন্যে তার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল।
বিনয়বাবু প্রথমটা কিছুই বললেন না, ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘরের চারিদিকে খানিকটা ঘুরে বেড়ালেন, তারপর বিমলের সামনে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, বিমল, বিমল! সুরেনবাবুর কাছে গিয়ে যা শুনলুম, তা ভয়ানক অতি ভয়ানক!
বিমল বললেন, আপনি কী শুনেছেন?
বিনয়বাবু বললেন, মৃণুর জন্যে আর আমাদের খোঁজাখুঁজি করে কোনও লাভ নেই।
তার মানে?
মৃণুকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কেন?
সুরেনবাবু বললেন, পঁচিশ বছর আগে দার্জিলিংয়ের আর-একবার একটি মেয়ে চুরি গিয়েছিল। সে মেম! সেই সময়ও এখানে নাকি মানুষ চুরির এইরকম হাঙ্গামা হয়। সেই মেয়ের সঙ্গে নাকি বিশ-পঁচিশজন পুরুষেরও আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।
আপনি কি মনে করেন, তার সঙ্গে এই ব্যাপারের কোনও সম্পর্ক আছে?
আমার তো তাই বিশ্বাস। এইসব কথা বলবার পর সুরেনবাবু এই লেখাটুকু দিলেন। পুরোনো ইংরেজি কাগজ ইন্ডিয়ান ডেলি নিউজ থেকে এটি তিনি কেটে রেখেছিলেন।
বিনয়বাবুর হাত থেকে কাগজখানি নিয়ে বিমল যা পড়লে তার সারমর্ম এইঃ
হিমালয়ে এক অজ্ঞাত রহস্যময় জীবের কথা শোনা যাচ্ছে। প্রথম এভারেস্ট অভিযানে যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরাও ফিরে এসে এদের কথা বলেছেন। তারা স্বচক্ষে এদের দেখেননি বটে, কিন্তু হিমালয়ের বরফের গায়ে এদের আশ্চর্য পায়ের দাগ দেখে এসেছেন। সে-সব পায়ের দাগ দেখতে মানুষের পদচিহ্নের মতন বটে, কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানুষেরও পায়ের দাগ তেমন মস্ত হয় না। স্থানীয় লোকেরা বলে, হিমালয়ের কোনও অজানা বিজন স্থানে বিচিত্র ও অমানুষিক সব দানব বাস করে। কখনও কখনও তারা রাত্রে গ্রামের আনাচে কানাচে এসে বড় বড় পাথর ছোড়ে। গভীর রাত্রে কখনও কখনও তাদের গলার আওয়াজও শোনা যায়। তারা মানুষের সামনে বড় একটা আসে না এবং মানুষেরাও তাদের সামনে যেতে নারাজ, কারণ সবাই তাদের যমের চেয়েও ভয় করে। তাদের কথা তুললেই হিমালয়ের গ্রামবাসীরা মহাআতঙ্কে শিউরে ওঠে। (আমরা যা বললুম, তা মনগড়া মিথ্যা কথা নয়। অধুনালুপ্ত ইংরেজি দৈনিকপত্র ইন্ডিয়ান ডেলি নিউজের পুরোনো ফাইল খুঁজলে সকলেই এর বিস্তৃত বিবরণ পাঠ করতে পারবেন। ইতি।–লেখক।)।
বিমল বললে, কাগজে যাদের কথা বেরিয়েছিল, কাল আমরাও বোধহয় তাদেরই কোনও কোনও জাতভাইয়ের খোঁজ পেয়েছি।
বিনয়বাবু বললেন, বোধহয় কেন বিমল, নিশ্চয়! হুঁ, আমরা নিশ্চয় তাদেরই কীর্তি দেখে এসেছি।
মানুষের পায়ের দাগের মতন দেখতে, অথচ তা অমানুষিক! আর, অমানুষিক সেই মাথার চুল। আর, অমানুষিক সেই অট্টহাসি! এদেরও অভ্যাস, বড় বড় পাথর ছোঁড়া। কে এরা, কে এরা, কে এরা? বলতে-বলতে বিমল উঠে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলে।–কুমার। রামহরি! বাঘা!
কুমার ও রামহরি তখনি ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়াল–তাদের পিছনে পিছনে বাঘা! পশু বাঘা, বুদ্ধিমান বাঘা,–সে কুকুর হলে কি হয়, তারও মুখে যেন আজ মানুষের মুখের ভাব ফুটে উঠেছে,–তাকে দেখলেই মনে হয় বিমলের ডাক শুনেই সে যেন বুঝতে পেরেছ যে, আজ তাকে বিশেষ কোনও দরকারি কাজ করতে হবে! সোজা বিমলের পায়ের কাছে এসে বাঘা বুক ফুলিয়ে এবং ল্যাজ তুলে দাঁড়াল–যেন সে বলতে চায়,–কী হুকুম হুজুর! গোলাম প্রস্তুত।
আদর করে বাঘার মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে বিমল বললে, কুমার! আমাদের জিনিসপত্তর সব তৈরি!
কুমার বললে, হ্যাঁ, বিমল!
বিমল বললে, আর একটু পরেই সন্ধে হবে। কিন্তু তার আগেই আমি ভুটিয়া বস্তিতে গিয়ে হাজির হতে চাই। আজ সারারাত সেইখানেই আমরা পাহারা দেব।
.
ভুটিয়া-বস্তির প্রায় দক্ষিণ-পূর্ব যে-দিক দিয়ে Pandam Tea Estate-এ যাওয়া যায়, সেইখানে এসে বিমল বললে, আজ সকালে এখানেই ভুটিয়াদের কান্নাকাটি শুনে গিয়েছি। আজ এইখানেই পাহারা দিয়ে দেখা যাক, কী হয়!…কিন্তু সকলে এক জায়গায় জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাছ থেকে খানিকখানিক তফাতে গিয়ে বসে পাহারা দেব। তাহলে অনেকখানি জায়গাই আমাদের চোখের ভিতরে থাকবে। আজ সারারাত ঘুমের কথা কেউ যেন ভেব না। দরকার হলেই বন্দুক ছুঁড়বে। রামহরি! বাঘাকে তুমি আমার কাছে দিয়ে যাও!
.
সন্ধ্যা গেল তার আবছায়া নিয়ে, রাত্রি এল তার নিরেট অন্ধকার নিয়ে। অন্য সময় হলে কাছে ওই ভুটিয়া-বস্তি থেকে হয়তো এখন অনেক রকম শব্দ বা গান-বাজনার ধ্বনি শোনা যেত, কিন্তু আজ সমস্ত পল্লী যেন গোরস্থানের মতো নিস্তব্ধ,–যেন ওখানে কোনও জীবই বাস করে না! শ্মশানে তবু মড়ার চিতা জ্বলে, কিন্তু ওখানে আজ একটিমাত্র আলোকবিন্দুও দেখা যাচ্ছে না! যেন ওখানে আজ কোনও কালো নিষ্ঠুর অভিশাপ অন্ধকারের সঙ্গে সর্বাঙ্গ মিশিয়ে দিয়ে নীরবে কোনও অজানা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন নিয়ে মারাত্মক খেলা করছে!