কুমার বললে, কিন্তু বিমল, এ-রহস্যের একটা কিনারা না করে আমরা ছাড়ব না। রীতিমতো প্রস্তুত হয়ে আবার আমাদের ফিরে আসতে হবে।
রামহরি চোখ কপালে তুলে বললে, এই ভূতের আড্ডায়?
বিমল কুদ্ধস্বরে বললে, হা, হ্যাঁ, এই ভূতের আড্ডায়! জানো না, আমরা কেন এখানে এসেছি? জানো না, বিনয়বাবু কেন আমাদের সাহায্য চেয়েছেন?
রামহরি মুখ কাচুমাচু করে বললে, না, না খোকাবাবু, আমাকে মাপ করো, ভূতের ভয়ে সেকথা আমি ভুলেই গিয়েছিলুম।
এমনি সব কথা কইতে কইতে সকলে রঙ্গিট রোড দিয়ে ভুটিয়া বস্তির কাছে এসে পড়ল। সেখানে এসে দেখলে, মহা গণ্ডগোল। চার-পাঁচজন স্ত্রীলোক চিৎকার করে কাঁদছে, আর তাদেরই ঘিরে দাঁড়িয়ে, ভুটিয়া, লিম্বু ও ল্যাপচা জাতের অনেকগুলো পাহাড়ি লোক উত্তেজিত ভাবে গোলমাল করছে।
তাদেরই ভিতর থেকে একজন মাতব্বরগোছের বুড়ো ভুটিয়াকে বেছে নিয়ে বিমল জিজ্ঞাসা করলে, এখানে এত শোরগোলের কারণ কী?
বুড়ো ভুটিয়াটা বিশৃঙ্খল ভাবে যে-সব কথা বললে, সেগুলো সাজিয়ে-গুছিয়ে নিলে এইরকম দাঁড়ায়
আজ কিছুকাল ধরে এখানে ভৌতিক উপদ্রব শুরু হয়েছে। বৌদ্ধ গুম্ফায় অনেক পূজা মানত করেও উপদ্রব কমেনি।
প্রথম প্রথম উপদ্রব বিশেষ গুরুতর হয়নি। পাহাড়ে পাহাড়ে যখন রাতের আঁধার নেমে আসত, মানুষরা যখন বিছানায় গিয়ে আশ্রয় নিত, তখন আশেপাশের জঙ্গলের ভিতর থেকে যেন কাদের চাঁচামেচি শোনা যেত!
তারপর নিশীথ-রাতে মাঝে মাঝে বস্তির লোকদের ঘুমের ব্যাঘাত হতে লাগল। ঘুম ভাঙলেই তারা শুনতে পায় বস্তির ভিতর দিয়ে যেন দুমদুম করে পা ফেলে মত্ত মাতঙ্গের দল। আনাগোনা করছে। তাদের পায়ের দাপে পাহাড়ের বুক যেন থরথর করে কাঁপতে থাকে। সে শব্দ শুনেই সকলের বুকের রক্ত জল হয়ে যায়, মায়ের কোলে ছেলেমেয়েরা ককিয়ে ওঠে। পাছে বাইরের তারা সে কান্না শুনতে পায়, সেই ভয়ে মায়েরা ছেলেমেয়ের মুখ প্রাণপণে চেপে ধরে আড়ষ্ট হয়ে থাকে, খুব সাহসী পুরুষদেরও এমন সাহস হয় না যে, দরজাটা একটু খুলে ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখে, বাইরে কাদের আগমন হয়েছে।
তারপর বস্তির ভিতর থেকে পর পর দুজন লোক অদৃশ্য হল। তারা দুজনেই দুটো বিলিতি হোটেলে কাজ করত–বাসায় আসতে তাদের রাত হত। তারা যে কোথায় গেল, কেউ তা জানে না।
তারপর এক চৌকিদার রাত্রে এক ভয়ানক ব্যাপার দেখলে। একতলা ছাদ-সমান উঁচু মস্ত বড় এক ছায়ামূর্তি বস্তির একটা পাঁচিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে চৌকিদারের বুকের পাটা ছিল খুব। ছায়ামূর্তিটাকে দেখেও সে ভাবলে, বোধহয় তার চোখের ভ্রম! ভালো করে দেখবার জন্যে সে দু-পা এগিয়ে গেল। অমনি ছায়ামূর্তিটা তাকে লক্ষ করে প্রকাণ্ড একখানা পাথর ছুঁড়ে মারলে। ভাগ্যক্রমে পাথরখানা তার গায়ে লাগল না! চৌকিদার তখনি যত জোরে ছোটা উচিত, তত জোরেই ছুটে পালিয়ে প্রাণ বাঁচালে। পরদিনই সে চৌকিদারি কাজ ছেড়ে দিলে!
এইসব কাণ্ডকারখানার কথা শুনে এক সাহেব কৌতূহলী হয়ে বস্তির ভিতরে রাত কাটাতে এল। রাত্রে কি ঘটল, কেউ তা জানে না। সকালে দেখা গেল, বস্তির পথে সাহেবের টুপি আর হাতের বন্দুক পড়ে রয়েছে, কিন্তু সাহেবের চিহ্নমাত্র নেই!
পরশু আর একজন ভুটিয়া বাসায় ফিরে আসেনি! কিন্তু যাদের বাড়িতে সে কাজ করত তারা বলেছে, রাতে সে বাসার দিকেই এসেছে। এখন পর্যন্ত তার কোনও পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তার মা-বোন-বউ কাঁদছে।
পুলিশের লোকেরা রোজ আসে। দিনের বেলায় তারা বুদ্ধিমানের মতো অনেক পরামর্শ করে, অনেক উপদেশ দেয় আর রাতে পাহারা দিতেও নাকি কসুর করে না। কিন্তু তারা পাহারা দেয় বোধহয় ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে। কারণ, এখনও গভীর রাতে প্রায়ই বস্তির পথে মহস্তির মতো কাদের ভারী ভারী পায়ের শব্দ শোনা যায়। রাত্রে এই দেবতা না অপদেবতাদের অনুগ্রহ, আর দিনেরবেলায় পুলিশের জাঁকজমক খানাতল্লাশ, বাবুসাহেব, আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছি! বস্তি ছেড়ে দলে দলে লোক পালিয়ে যাচ্ছে।
.
চার । রাত্রের বিভীষিকা
বিমল ও কুমার বাসায় বসে বসে মাঝে মাঝে স্যান্ডউইচে কামড় ও মাঝে মাঝে চায়ের পেয়ালার চুমুক দিচ্ছিল। দুইজনেরই মন খারাপ, কারুর মুখেই কথা নেই। বাঘা অতশত বোঝে না, কখন চিকেন-স্যান্ডউইচের একটুখানি প্রসাদ তার মুখের কাছে এসে পড়বে সেই মধুর আশাতেই সে বিমল ও কুমারের মুখের পানে বারংবার লোভের দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে!
বিনয়বাবু বাসায় নেই। সুরেনবাবু এখানকার একজন বিখ্যাত লোক–বহুকাল থেকে দার্জিলিংয়েই স্থায়ী। এখানে এসে তার সঙ্গে বিনয়বাবুর অল্পস্বল্প আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। সুরেনবাবু আজ হঠাৎ কি কারণে বিনয়বাবুকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
চায়ের পেয়ালার শেষ চুমুক দিয়ে কুমার বললে, বিনয়বাবুর ফিরতে তো বড় বেশি দেরি হচ্ছে!
বিমল বললে, হুঁ। এত দেরি হওয়ার তো কথা নয়। তাঁকে নিয়ে সুরেনবাবুর এমনকী দরকার?
কুমার বললে, এদিকে আমাদের বেরুবার সময় হয়ে এল, বন্দুকগুলো সাফ করা হয়েছে কিনা দেখে আসি।
বিমল বললে, কেবল বন্দুক নয় কুমার! প্রত্যেকের ব্যাগে কিছু খাবার, ছোরা-ছুরি, ইলেকট্রিক টর্চ, খানিটা পাকানো দড়ি–অর্থাৎ হঠাৎ কোনও বিপজ্জনক দেশে যেতে হলে আমরা যে-সব জিনিস নিয়ে যাই, তার কিছুই ভুললে চলবে না।