বিমল তার কাঁধে-ঝোলানো ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটি ক্যামেরা বার করে বললে, এই আশ্চর্য পায়ের দাগের একটা মাপ আর ফটো নিয়ে রাখা ভালো। পরে দরকার হবে।
বিনয়বাবু গম্ভীর স্বরে বললেন, আমাদের আর এখানে অপেক্ষা করবার দরকার নেই। যা দেখছি তাই-ই যথেষ্ট। আমি বেশ বুঝতে পারছি, মৃণুকে খুঁজে আর কোনওই লাভ নেই– নরখাদক রাক্ষসদের কবলে পড়ে সে-অভাগীর প্রাণ– বলতে বলতে তার গলার আওয়াজ ভারী হয়ে এল, তিনি আর কথা কইতে পারলেন না।
কুমার বললে, বিনয়বাবু, আপনার মতন বুদ্ধিমান লোকের এত শীঘ্র বিচলিত হওয়া উচিত নয়। মৃণু যে এই নরখাদকদের পাল্লায় পড়েছে, এমন কোনও প্রমাণ নেই! আমার বিশ্বাস, আমরা তাকে ঠিক খুঁজে বার করতে পারব।
বিনয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, তোমার কথাই সত্য হোক।
বিমল বললে, বিনয়বাবু, আমরা যখন ময়নামতীর মায়াকাননে গিয়ে পড়েছিলুম, তখন দেখেছিলুম পৃথিবীর আদিম জন্তুদের বিষয়ে আপনার অনেক পড়া শোনা আছে। আপনি বানর জাতীয় কোনও দানবের কথা বলতে পারেন–আসলে যারা বানরও নয়, মানুষও নয়!
বিনয়বাবু বললেন, বানরদের মধ্যে দানব বলা যায় গরিলাদের। কিন্তু তারা বড়-জাতের বানরই। পণ্ডিতরা বহুকাল ধরে বানর আর মানুষের মাঝামাঝি যে জীবকে অন্বেষণ করছেন, গরিলারা তা নয়। তবে সম্প্রতি দক্ষিণ আমেরিকায় এক অদ্ভুত জীবের খোঁজ পাওয়া গেছে। দক্ষিণ আমেরিকায় টারা (Tarra) নামে এক নদী আছে। সেই নদীর ধারে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দুটো মস্তবড় বানর-জাতীয় জীব হঠাৎ একদল মানুষকে আক্রমণ করে। তাদের একটা মদ্দা, আর একটা মাদি। মানুষের দল আক্রান্ত হয়ে গুলি করে মাদিটাকে মেরে ফেলে, মদ্দাটা পালিয়ে যায়। মাদিটা পাঁচফুটের চেয়েও বেশি লম্বা। সুতরাং আন্দাজ করা যেতে পারে যে, মদ্দাটা হয়তো মাথায় ছয় ফুট উঁচু হবে। আমি মৃত জীবটার ফোটো দেখেছি। তাকে কতকটা বানর আর মানুষের মাঝামাঝি জীব বলা চলে। কিন্তু তুমি এসব কথা জানতে চাইছ কেন? তোমার কি সন্দেহ হয়েছে যে, ওই পায়ের দাগগুলো সেইরকম কোনও জীবের?
বিমল বললে, সন্দেহ তো অনেক রকমই হচ্ছে, কিন্তু কোনওই হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এ পায়ের দাগ গরিলার মতো কোনও বানরেরও নয়, মানুষেরও নয়–এ হচ্ছে বানর আর মানুষের চেয়ে ঢের বেশি বড় কোনও জীবের। এরা নরমাংস খায়, কিন্তু বানর-জাতীয় কোনও জীবই নরমাংসের ভক্ত নয়। মানুষই বরং অসভ্য অবস্থায় নরমাংস ভক্ষণ করে। কাল আমরা যে অট্টহাসি শুনেছি, বানরের গলা থেকে তেমন অট্টহাস্য কেউ কোনওদিন শোনেনি। বানররা বা আর কোনও জানোয়াররাই হাসতে পারে না, হাসিও হচ্ছে মানুষেরই নিজস্ব জিনিস। মানুষের মতন পায়ের দাগ, মাথায় লম্বা লম্বা চুল, দৈর্ঘ তার বারো-চোদ্দো ফুট কি আরও বেশি, মানুষেরই মতন হাসতে পারে, এমন জীবের কথা কে শুনেছে, এমন জীবকে কে দেখেছে, তাও আমরা জানি না। কোথায় তাদের ঠিকানা, তাই বা কে বলে দেবে?
রামহরি বললে, তাদের ঠিকানা হচ্ছে কৈলাসে। আদ্যিকালে তারাই দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করে। দিয়েছিল, আর একালে তারাই এসেছে আমাদের মুণ্ডুপাত করতে।…তারা কেমন দেখতে, কী। করে, কি খায়, কোথায় থাকে, একথা তোমাদের জানবার দরকার কি বাপু?
রামহরির কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই বিনয়বাবুর মাথার উপর দিয়ে প্রকাণ্ড একখানা পাথর ঠিকরে গিয়ে দুম করে মাটিতে পড়ে গড়িয়ে গেল! ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে না বুঝতে আরও চার-পাঁচখানা তেমনি বড় বড় পাথর তাঁদের আশে-পাশে, মাঝখানে এসে পড়ল– এক একখানা পাথর ওজনে একমন-দেড়মনের কম হবে না।
বিমল একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে বললে,পালাও–পালাও! ছোটো।
দৌড়, দৌড়, দৌড়! প্রত্যেকে ছুটতে লাগল–কালবোশেখির ঝড়ের বেগে! পাথর-বৃষ্টির তোড় দেখে বাঘারও সমস্ত বীরত্ব উপে গেল, তার বুঝতে দেরি লাগল না যে, এখন পলায়নই হচ্ছে প্রাণ বাঁচাবার একমাত্র ভালো উপায়! ওরকম প্রকাণ্ড পাথর একখানা মাথায় পড়লে মানুষ তো ছার, হাতি-গন্ডারকেও কুপোকাত হতে হবে!
অনেকদূর এসে সবাই আবার দাঁড়াল। খানিকক্ষর ধরে হাঁপ ছাড়বার পর কুমার বললে, ওঃ, আজ আর একটু হলেই ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে গিয়েছিল আর কি!
রামহরি বললে, এসব হচ্ছে আমার কথা না শোনার শাস্তি। জানো না, শান্তরে আছে– ঠিক দুপুরবেলা, ভূতে মারে ঢেলা!
বিমল বিরক্ত হয়ে বললে, তোমার শাস্ত্র নিয়ে তুমিই থাকো রামহরি, এসময়ে আর তোমার শাস্ত্র আউড়ে আমাদের মাথা গরম করে দিও না।
বিনয়বাবু বললেন, আর এখানে দাঁড়ানো না, একেবারে বাসায় গিয়ে ওঠা যাক চলল।
চলতে চলতে বিমল বললে, অমন বড় বড় পাথর যারা ছোট ছোট ঢিলের মতো ছুঁড়তে পারে, তাদের আকার আর জোরের কথা ভাবলেও অবাক হতে হয়!
কুমার বললে, আর এটাও বেশ বোঝা যাচ্ছে, আমরা ওখানে বসে যখন ওদের কথা নিয়ে আলোচনা করছিলুম, তখন ওরাও লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের সকলকে লক্ষ করছিল।
বিনয়বাবু বললেন, তাদের শক্তির যে পরিচয়টা পাওয়া গেল তাতে তো মনে হয় ইচ্ছে করলেই তারা আমাদের কড়ে আঙুলে টিপে মেরে ফেলতে পারত। কিন্তু তা না করে তারা লুকিয়ে লুকিয়ে পাথর ছুঁড়ে আমাদের মারতে এল কেন?
বিমল বললে, এও একটা ভাববার কথা বটে। হয়তো তারা আত্মপ্রকাশ করতে রাজি নয়। হয়তো দিনের আলো তারা পছন্দ করে না। হয়তো পাথর ছোঁড়াটা তাদের খেয়াল।