ভয় পায়নি কেবল বাঘা, তার ঘন ঘন ল্যাজ নাড়া দেখেই সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। সে বোধ হয় ভাবছিল, এ এক মস্ত মজার খেলা!
গর্তের মুখের দিকে মুখ রেখে বিমল হুমড়ি খেয়ে বসে রইল–সেই জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে।
দেখতে-দেখতে সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমেই ঘন হয়ে বিমলের দৃষ্টিকে অন্ধ করে দিলে। কান পেতেও সেই ধুপধুপুনি শব্দ আর কেউ শুনতে পেলে না।
বুনো হাওয়া গাছে গাছে দোল খেয়ে গোলমাল করছিল, তাছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। সেই কনকনে ঠান্ডা হাওয়া গর্তের ভিতরে ঢুকে সকলের গায়ে যেন বরফের ছুরি মারতে লাগল।
কুমার মৃদুস্বরে বললে, বোধ হয় আর কোনও বিপদের ভয় নেই,–এইবারে বাইরে বেরিয়ে পড়া যাক!
ঠিক যেন তার কথার প্রতিবাদ করেই খানিক তফাত থেকে কে অট্টহাসি হেসে উঠল। খুব বড় গ্রামোফোনের হর্নে মুখ রেখে অট্টহাসি করলে যেমন জোর আওয়াজ হয়, সে হাসির শব্দ যেন সেইরকম, কিন্তু তার চেয়েও শুনতে ঢের বেশি ভীষণ!
সে হাসি থামতে না থামতে আরও পাঁচ-ছয়টা বিরাট কণ্ঠে তেমনি ভয়ানক অট্টহাস্যের স্রোত ছুটে গেল! সে যেন মহা মহাদানবের হাসি, মানুষের কান এমন হাসি কোনওদিনই শোনেনি। যাদের হাসি এমন, তাদের চেহারা কেমন?
হঠাৎ জঙ্গলের ভিতর থেকে আগুনের আভা এবং মাঝে মাঝে তার শিখাও দেখা গেল।
বিমল চুপিচুপি বললে, আগুন জ্বেলে কারা ওখানে কী করছে?
রামহরি বললে, ভূতেরা আগুন পোয়াচ্ছে!
বিমল বললে, লুকিয়ে লুকিয়ে গিয়ে একবার উঁকি মেরে দেখে আসব নাকি?
রামহরি টপ করে তার হাত ধরে বললে, থাক, অত শখে আর কাজ নেই।
মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক কণ্ঠের অদ্ভুত চিৎকার জেগে জেগে উঠে সেই পাহাড়ে-রাত্রির তন্দ্রা ভেঙে দিতে লাগল। সে রহস্যময় চিৎকারের মধ্যে এমন একটা হিংসার ভাব ছিল যে, শুনলেই বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে। সে যে কাদের কণ্ঠস্বর তা জানবার বা বোঝবার যো ছিল না বটে, কিন্তু সে চিৎকার যে মানুষের নয়, এটুকু বুঝতে বিলম্ব হয় না।
বিমল বললে, আ-হা-হা-হা, থাকত আমার বন্দুকটা সঙ্গে, তাহলে ওদের চালাকি এখনি বার করে দিতুম।
কুমার বললে, আরে রাখো তোমার বন্দুকের কথা। কাল সারারাত কেটেছে ট্রেনে আমার এখন খিদে পেয়েছে, আমার এখন ঘুম পেয়েছে।
বিমল বললে, ও পেটের আর ঘুমের কথা কালকে ভেব, আজকের রাতটা দেখছি এখানেই কাটাতে হবে।
.
সদ্যজাগা সূর্য যখন হিমালয়ের শিখরে শিখরে সোনার মুকুট বসিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার অবসর বিমলদের মোটেই ছিল না।
মাঝরাতের পরেই জঙ্গলের আগুন নিবে ও সেই আশ্চর্য চিৎকার থেমে গিয়েছিল এবং তখন থেকেই গর্ত থেকে বেরুবার জন্যে বিমল ও কুমার ছটফটিয়ে সারা হচ্ছিল, কিন্তু বিনয়বাবু ও রামহরির সজাগ পাহারায় এতক্ষণ তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়নি।
এখন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই তারা এক এক লাফে গর্তের বাইরে এসে পড়ল এবং আবার স্বাধীনতা পেয়ে তাদের চেয়েও কম খুশি হল না বাঘা, কারণ যেখানে আগুন জ্বলছে। ও চিৎকার হচ্ছে সেখানটায় একবার ঘুরে আসবার জন্যে তারও মন কাল সারারাত আনচান করেছে। তাই গর্ত থেকে বেরিয়েই বাঘা সেই জঙ্গলের ভিতরে ছুট দিলে এবং তার পিছনে পিছনে ছুটল বিমল ও কুমার।
কাল যেখান থেকে তারা পালিয়ে এসেছে, আজ তারা প্রথমেই সেইখানে গিয়ে হাজির হল। দেখেই বোঝা গেল, কাঠ কাটরা এনে কারা সেখানে সত্য-সত্যই আগুন জ্বেলেছিল। ভস্মের স্তূপ থেকে তখনও অল্প অল্প ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
মাটির উপরেও ইতস্তত ছাই ছড়ানো রয়েছে। সেইদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বিমল বললে, দেখো।
কুমার অবাক হয়ে দেখলে, সেখানকার ছাইগাদার উপরে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড তেমনি মানুষের মতন-অমানুষের পায়ের দাগ রয়েছে অনেকগুলো!
বাঘা সেই এক-একটা পায়ের দাগ শোকে, আর রেগে গরগর করে ওঠে! তারও বুঝতে দেরি লাগল না যে, এসব পায়ের দাগ রেখে গেছে যারা, তারা তাদের বন্ধু নয়!
.
ততক্ষণে বিনয়বাবুর সঙ্গে রামহরিও সেখানে এসে হাজির হয়েছে। বিমলকে ডেকে সে গম্ভীর ভাবে বললে, খোকাবাবু, আমার কথা শোনো। হিমালয় হচ্ছে বাবা মহাদেবের ঠাঁই। বাবা মহাদেব হচ্ছেন ভূতেদের কর্তা। এ-জায়গাটা হচ্ছে ভূতপ্রেতদের আড্ডা। যা দেখবার, সবই তো দেখা হল–আর এখানে গোলমাল কোরো না, লক্ষ্মীছেলের মতো ভালয় ভালয় বাসায়। ফিরে চলো!
বিনয়বাবু হঠাৎ বলে উঠলেন, এ কী ব্যাপার! সেই ভুটিয়াটার লাশ কোথায় গেল?
এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে কুমার বললে, নিশ্চয় কোনও জন্তু-টন্তু টেনে নিয়ে গিয়েছে!
রামহরি বললে, ওই যে, তার জামা আর ইজের ওইখানে পড়ে রয়েছে।
বিমল একটা গাছের ভাঙা ডাল দিয়ে ছাইগাদা নাড়তে নাড়তে বললে, কুমার, কোনও জন্তু-টন্তুতে সে লাশ টেনে নিয়ে যায়নি, সে লাশ কোথায় গেছে তা যদি জানতে চাও তবে। এই ছাইগাদার দিকে নজর দাও।
ও কী! ছাইয়ের ভেতরে অত হাড়ের টুকরো এল কোথা থেকে?
হ্যাঁ, আমারও কথা হচ্ছে তাই। কুমার, কাল রাতে যারা এখানে এসেছিল, তারা সেই ভুটিয়াটার দেহ আগুনে পুড়িয়ে খেয়ে ফেলেছে!
রামহরি ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল।
.
তিন। রামহরির শাস্ত্র-বচন
সকলে স্তম্ভিতভাবে সেইখানে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। কেবল বাঘা পায়ের দাগগুলো শুঁকতে শুঁকতে অজ্ঞাত শত্রুদের বিরুদ্ধে তখনও কুকুর-ভাষায় গালাগালি বৃষ্টি করছিল।