হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ সেইখানে দাঁড়িয়ে থেকে, মিস্টার দাস চিন্তিত মুখে নীচে নেমে বৈঠকখানায় গিয়ে ঢুকলেন। সেখানে তখন স্বাস্থ্যনিবাসের ভাড়াটে বাসিন্দাদের জটলা শুরু হয়ে গেছে। এবং মিসেস দাস সকলের সামনে দাঁড়িয়ে হাত-মুখ নেড়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন–পৃথিবীতে যতরকমের জীব আছে তার মধ্যে সবচেয়ে উঁচা জীব হচ্ছে, কুকুর। আর পৃথিবীতে যতরকমের কুকুর আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে উঁচা কুকুর হচ্ছে, ডগি। স্বাস্থ্যনিবাসের অতিথিদের ওপরে ডগির কোনওই দরদ নেই। ভদ্রলোককে সে আজ কামড়ে দিয়েছে! না জানি এখন তার কতই কষ্ট হচ্ছে!
মিস্টার দাস বললেন, তোমার অতিথির জন্যে তোমাকে কিছুই ভাবতে হবে না! বোধ। হয় তাঁর বিশেষ কিছুই হয়নি। তার চেয়ে লগেজগুলো ঘরের ভেতরে আনাবার ব্যবস্থা করো।
পিছন থেকে গলার আওয়াজ এল, না, না–আমার কিছুই হয়নি! লগেজগুলো তাড়াতাড়ি আমার ঘরে পাঠাবার বন্দোবস্ত করুন।
সকলে ফিরে দেখলে জামা কাপড় বদলে যাত্রী আবার নীচে নেমে এসেছে। লগেজগুলো যেই ঘরের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হল অমনি যাত্রীর আর তর সইল না। তখনি ব্যস্তভাবে সে পোর্টম্যান্টো ও বাক্সগুলো খুলে ফেললে। তাদের ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ল মোটা বোতল, বেঁটে বোতল, ঢ্যাঙা বোতল; কোনওটার রং নীল, কোনওটার লাল, কোনওটার বা সবুজ; অনেকগুলোর গায়ে বড় বড় হরফে বিষ বলে লেখা রয়েছে। পাতলা পুরু লম্বা ছোট কত রকমের বই! টেবিলের উপরে ওইসব শিশি-বোতল সাজিয়ে নিয়ে, সামনের চেয়ারে বসে যাত্রী এক মনে কি কাজ করতে লাগল।
দুপুরবেলায় মিসেস দাস যখন উপরে এলেন, তখন ঘরের চেহারা দেখেই তার চক্ষু স্থির! প্যাকিংয়ের চটে, খড়ের টুকরোয় ও দড়িদড়ায় তার ঘরের মেঝে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। তিনি তখনি সেই জঞ্জালগুলোকে নিজের হাতে ঘরের ভিতর থেকে বিদায় করে দিতে লাগলেন। যাত্রী তখন এমন এক মনে কাজ করছিল যে মিসেস দাসের অস্তিত্ব টেরই পেলে না!
মিসেস দাস ঘর পরিষ্কার করে বললেন, আপনি চারদিক এমন নোংরা করে রাখবেন না। তাহলে স্বাস্থ্যনিবাসের বদনাম হবে।
যাত্রী চমকে ফিরে তাকালে। তখন সে চোখ থেকে চশমা খুলে রেখেছিল। মিসেস দাসের মনে হল তার চোখের কোটরে যেন চোখদুটো নেই, খালি দুটো গর্ত! মিসেস দাস ভাবলেন তারই দেখবার ভুল। যাত্রী তখনি চশমাখানা আবার পরে নিলে।
তারপর বললে, আপনি সাড়া না দিয়ে ঘরের ভেতরে এলেন কেন?
মিসেস দাস বললেন, আমি সাড়া দিয়েছিলুম, আপনি শুনতে পাননি–
যাত্রী বাধা দিয়ে বললে, হতে পারে কিন্তু সামান্য একটু শব্দেই আমার কাজের বড় ক্ষতি হয়।
মিসেস দাস বললেন, তাহলে আপনি তো এক কাজ করতে পারেন! এবার থেকে আপনি যখন কাজ করবেন, ঘরের দরজায় ভেতর থেকে খিল দিয়ে রাখবেন।
এ খুব সঙ্গত কথা।
কিন্তু মশাই, এই খড়গুলো–
যাত্রী আবার বাধা দিয়ে বললে, ঘরের ভেতরে খড়কুটো পড়লে তা নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না। যদি কিছু লোকসান হয় আপনি আমার কাছ থেকে টাকা আদায় করে নেবেন।
মিসেস দাস কেবল বুদ্ধিমান স্ত্রীলোক নন, তাঁকে নাছোড়বান্দাও বলা যেতে পারে। তিনি বললেন, কিন্তু আজ এই যে আপনি আমার ঘর-দোর নোংরা করেছেন–
যাত্রী বললে, তার জন্যে আমার পাঁচ টাকা জরিমানা হল। ব্যস, এখন আর কোনও কথা নয়।
মিসেস দাস খুব খুশিমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাত্রীর কর্কশ কথা ও ব্যবহারের জন্যে এখন আর তার মনের উপরে কোনও দাগই পড়ল না, কারণ এমন পাঁচ টাকা জরিমানা পেলে মনের সব ময়লাই ধুয়ে যায়!
এরই খানিকক্ষণ পরে মিসেস দাস যখন আবার যাত্রীর ঘরের সুমুখ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন বন্ধ দ্বারের ওপার থেকে হঠাৎ একটা ঝনঝনানির আওয়াজ তাঁর কানে গিয়ে ঢুকল। কে যেন শিশি বোতল সাজানো টেবিলের উপরে সজোরে এক ঘুসি বসিয়ে দিলে! তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং তারপরেই যাত্রীর গলার আওয়াজে শুনলেন–আমি আর পারছি না, আমি আর পারছি না!–এর জন্যে আমার সারা জীবনই কেটে যাবে! অস্থির হব না?
অস্থির না হয়ে আর উপায় কি? হারে নির্বোধ!
.
চতুর্থ । হাত নেই–হাতা
শ্রীপুরের স্বাস্থ্যনিবাসে যাত্রীর দিন একভাবেই কাটতে লাগল।
শ্রীপুরের ঘরে-ঘরে কিন্তু গুজবের অন্ত নেই। যাত্রীর সেই আপাদমস্তক ঢাকা ব্যান্ডেজ করা কিম্ভুতকিমাকার মূর্তি দেখলেই শ্রীপুরের পথ থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভূত! ভূত! বলে চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে যায়! পথের উপরে রাত্রিকালে যাত্রীর মূর্তি দেখলে ছেলেমেয়েদের বাপেদের গা ছমছম করে ওঠে! যাত্রী কারুর সঙ্গে মেশে না, তার পরিচয়ও কেউ জানে না, এত ঠাঁই থাকতে কেন যে সে শ্রীপুরে এসে আবির্ভূত হয়েছে, সে রহস্যও কেউ বুঝতে পারে না! শ্রীপুরের পাড়ায় পাড়ায় যাত্রীর কথা নিয়ে উত্তেজনার অন্ত নেই!
রতনবাবুর আগেকার মত তো আমরা আগেই জানতে পেরেছি। আগে তিনি যাত্রীকে খুনি ও ডাকাত বলেই প্রচার করতেন। এখন তাঁর মতে, যাত্রী হচ্ছে সর্বনেশে স্বদেশি বোমাওয়ালা!
যাত্রী সারাদিন বন্ধ দরজার আড়ালে বসে তার শিশি বোতল আর বইগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে, মাঝে মাঝে ঘরের ভিতরে পায়চারি করতে করতে নিজের মনেই নিজের সঙ্গে কথাবার্তা কয় এবং যখন সন্ধ্যার অন্ধকারে চারিদিক আচ্ছন্ন হয়ে আসে, তখন আগাপাশতলা জামাকাপড়ে মুড়ে শ্রীপুরের নির্জন পথে একটি বেড়াতে বেরোয়!