যাত্রী বাধা দিলে বললে, এখন আপনারা এ-ঘরে যা করতে এসেছেন, করুন বলেই সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলে।
মিসেস দাস আর সেখানে দাঁড়ালেন না রাগে গগস করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
রতনবাবু একখানা টুলের উপর উঠে দাঁড়িয়ে, দেয়াল-ঘড়ির ডালা খুলে তার ভিতরটা পরীক্ষা করতে করতে হঠাৎ একবার মুখ তুলে দেখলেন, যাত্রী তার নীল-রঙা ঠুলি-চশমার ভিতর দিয়ে একদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটো দেখা যাচ্ছিল না বটে, কিন্তু রতনবাবুর মনে হল যেন দু-দুটো অন্ধকারের গর্ত কটমট করে তাকে নিরীক্ষণ করছে! তার বুকটা ছাঁৎ করে উঠল! সে ভাবটা সামলে নেওয়ার জন্যে রতনবাবু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, দেখছেন মশাই, আজকে আকাশের অবস্থাটা মোটেই ভালো নয়!
যাত্রীর মূর্তি একটুও নড়ল না। কিন্তু সে কর্কশ স্বরে বলে উঠল, একটা ঘড়ি ঠিক করতে কতক্ষণ লাগে? তাড়াতাড়ি কাজ সেরে সরে পড়ন না!
রতনবাবু অপ্রস্তুত স্বরে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, আজ্ঞে হ্যাঁ! এই, আর এক মিনিটেই হয়ে যাবে! তারপর মুখ বুজে চটপট মেরামতি কাজ সেরে তিনি সে-ঘর থেকে অপরাধীর মতো সুড় সুড় করে বেরিয়ে গেলেন।
স্বাস্থ্যনিবাস থেকে বাইরে বেরিয়ে রতনবাবু নিজের বাসার দিকে অগ্রসর হলেন। খানিক পরেই মিস্টার দাসের সঙ্গে দেখা।
তাকে দেখেই মিস্টার দাস বলে উঠলেন, আরে, আরে, রতন যে! খবর কি?
রতনবাবু মুখ ভার করে বললেন, দাস, খবর বড় ভালো নয়!
কেন?
তোমার বাড়িতে একটা খুনে কি ডাকাত এসে আড্ডা জমিয়েছে!
মিস্টার দাস চমকে উঠে বললেন, কি বলচ হে?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ফেরার আসামি! দেখছি স্বাস্থ্যনিবাস এবার পুলিশের জিম্মায় যাবে।
মিস্টার দাস বললেন, বটে, বটে, তাই নাকি? আচ্ছা, এখনি গিয়ে আমি সব ব্যবস্থা করছি। এই বলেই দ্রুতপদে বাড়িমুখো হলেন।
কিন্তু স্বাস্থ্যনিবাসে ফিরে তিনি একটি টু শব্দ করবার আগেই মিসেস দাসই তাকে সচিৎকারে আক্রমণ করলেন। বললেন, তোমার মতন মানুষের হাতে পড়ে হাড় আমার ভাজা ভাজা হয়ে গেল! আমি মরছি নিজের জ্বালায়, আর উনি বেড়াচ্ছেন ফুর্তি করে। বাড়ি থেকে কখন বেরিয়েছিলে বলো দিকি?
মিস্টার দাস আমতা আমতা করে বললেন, একেবারে রণরঙ্গিনী মূর্তি ধারণ করে আমাকে আর ভয় দেখিও না গো! আমি তো তোমার কাজেই বাইরে গিয়েছিলুম!
মিসেস দাস একটু নরম হয়ে বললেন, এখানে একজন নতুন লোক এসেছে, আর তুমি রইলে বাইরে। ফরমাজ কে খাটে বলো দিকি?
মিস্টার দাস বললেন, নতুন লোক? কে নতুন লোক? শুনলুম তাকে নাকি চোর-ডাকাত খুনের মতন দেখতে?
মিসেস দাস তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, সে তো আমাদের জামাই নয়! সে ভালো কি মন্দ দেখতে, তা নিয়ে আমাদের দরকার কি?
মিস্টার দাস বললেন, না, তা নিয়ে আমাদের দরকার নেই বটে, কিন্তু তাকে পুলিশের দরকার হতে পারে।
মিসেস দাস রাশভারী চালে বললেন, থামো, থামো! তোমাকে আর বেশি বাজে বকতে হবে না, নিজের চরকায় তেল দাওগে যাও!
মিস্টার দাসের আর কিছু বলবার সাহস হল না। তিনি মনে মনে এই ভাবতে ভাবতে অন্যদিকে চলে গেলেন, মেয়েরা চিরকালই এমন বোকা হয়! বিপদে না পড়লে তারা বিপদকে বিপদ বলে বুঝতেই পারে না!
.
তৃতীয় । পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ওঁচা জীব
পরের দিন সকালবেলায় যাত্রীর লগেজগুলো এসে হাজির হল।
গাড়ি থেকে লগেজগুলো যখন নীচে নামানো হচ্ছিল, যাত্রীও তখন সেখানে এসে ব্যস্ত হয়ে তদ্বির করতে লাগল। লগেজের মধ্যে ছিল গোটা-দুয়েক বড় বড় পোর্টম্যান্টো, দু-বাক্স ভর্তি মোটা মোটা বই, আর অনেকগুলো শিশি-বোতল–তাদের ভিতরে টলটল করছে নানান রঙের ওষুধের মতন তরল জিনিস।
মিস্টার দাসের একটা কুকুর ছিল, তার নাম হচ্ছে ডগি। যাত্রী তাকে দেখতে পায়নি, কিন্তু সে যাত্রীকে দেখতে পেলে। দেখে সে আর বেশি কিছু করলে না, দৌড়ে এসে কেবল যাত্রীর পায়ের উপরে দিলে দাঁত খিঁচিয়ে এক কামড়! মিস্টার দাস তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে ডগিকে এক লাথি মেরে নিজের বীরত্বের পরিচয় দিলেন। ডগি কেঁউ কেঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে সরে পড়ল। যাত্রীর কাপড়ের খানিকটা ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে গিয়েছিল, সেও তাড়াতাড়ি বাড়ির উপরে উঠে গেল।
মিসেস দাস বললেন, যেমন মনিব তার তেমনি কুকুর! তোমার কুকুর যদি অতিথিদের সঙ্গে এইরকম ব্যবহার করে তাহলে শিগগিরিই আমাদের স্বাস্থ্যনিবাস তুলে দিতে হবে!
মিস্টার দাস বললেন, সত্যি, ডগির অপরাধ আমি স্বীকার করছি! ভদ্রলোকের কি হল আমি এখুনি গিয়ে দেখে আসছি।
তিনি সিধে উপরে গিয়ে উঠলেন। যাত্রীর ঘরের দরজা খোলাই ছিল, চৌকাঠ পার হয়ে তিনি ঘরের ভিতর গিয়ে দাঁড়ালেন।
ঘরের জানলাগুলো আগেকার মতোই বন্ধ ছিল। ভিতরের আধা-অন্ধকারে স্পষ্ট করে কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু মিস্টার দাস যেন কি একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেলেন। যেন ছায়া ছায়া কি একটা নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে, যেন একখানা বাহুহীন হস্ত শূন্যে ভাসতে ভাসতে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। তারপর কী যে হল স্পষ্ট বোঝা গেল না, কিন্তু কে যেন এক ধাক্কা মেরে তাঁকে ঘরের বাইরে তাড়িয়ে দিলে! সঙ্গে সঙ্গে দুম করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল ও খিল দেওয়ার শব্দ হল! ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটল যে মিস্টার দাস কিছুই আন্দাজ করতে পারলেন না। ছায়াময় ঘর, অস্পষ্ট একটা আকারের আভাস ও বিষম৷ এক ধাক্কা! অত্যন্ত অবাক হয়ে মিস্টার দাস ভাবতে লাগলেন, তিনি স্বচক্ষে যা দেখলেন সেটা হচ্ছে কী?