মিসেস দাস মনে মনে এমনই সব কথা নিয়ে ভোলা-পাড়া করছেন, এমন সময় যাত্রী হঠাৎ বললে, ইস্টিশানে আমার কতকগুলো লগেজ পড়ে আছে। সেগুলো আবার কি উপায় করা যায় বলুন দেখি?
যাত্রীর গলার আওয়াজ আর তেমন কর্কশ নয়। মিসেস দাস ভাবলেন, তার স্বাস্থ্যনিবাসের সুখাদ্য খেয়ে তার মেজাজ নরম হয়ে গিয়েছে! যাহোক, কথা-কইতে-নারাজ যাত্রীর সঙ্গে কথা কইবার সুযোগ পেয়ে মিসেস দাস খুব খুশি হয়ে, বললেন, সেজন্যে আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব অখন।
যাত্রী বললে, আজকেই সে ব্যবস্থা হতে পারে কি?
মিসেস দাস মাথা নেড়ে বললেন, আজ আর হয় না। মিস্টার দাস তার এক বন্ধুকে দেখতে গেছেন, কখন ফিরবেন বলা যায় না। বুঝলেন মশাই? তাঁর বন্ধুটি ট্রেন থেকে পড়ে মাথা ফাটিয়ে বসে আছেন!–এই বলে যাত্রীর ব্যান্ডেজ-করা মুখের দিকে একবার কৌতূহলী। দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার শুরু করলেন, আজকাল পথে-ঘাটে দৈব দুর্ঘটনা বড় বেশি বেড়ে গেছে, না মশাই?
মিসেস দাসের ইচ্ছা যে, যাত্রী নিজের মুখেই প্রকাশ করে তার মুখে ও মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা কেন? কিন্তু যাত্রী সে ধারও মাড়ালে না, হঠাৎ গলার আওয়াজ বদলে বলে উঠল, আচ্ছা, আমার লগেজ কাল এলেই চলবে। এখন আমি একটু একা থাকতে চাই।
আমার সঙ্গে গল্প করতে রাজি নয়, এ কীরকম অসভ্য লোক?
সবিস্ময়ে এই কথা ভাবতে ভাবতে অত্যন্ত অভিমান-ভরে মিসেস দাস সে-ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মিসেস দাস একেবারে নীচের বৈঠকখানায় গিয়ে ধপাস করে একখানা চেয়ারের উপরে বসে পড়লেন। ঠিক বৈঠকখানার উপরেই ছিল যাত্রীর ঘর। সে যে নিজের মনে ঘরের ভিতরে পায়চারি করছে, তারই আওয়াজ মিসেস দাসের কানের ভিতর এসে ঢুকল।
.
দ্বিতীয়। রতনবাবুর সন্দেহ
খানিক পরে মিস্টার দাসের এক বন্ধু সেই বৈঠকখানার এসে হাজির হলেন। তার নাম রামরতন–কিন্তু সবাই তাকে ডাকে রতনবাবু বলে। তিনি মাঝে মাঝে এখানে তার বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর সঙ্গে গল্প করতে আসেন এবং সেই সময়ে দু-একখানা টোস্ট ও এক পেয়ালা চা পেলেই খুব খুশি হয়ে সদ্ব্যবহার করে যান। স্বামীর বন্ধুদের জন্যে এরকম বাজে-খরচ হওয়া মিসেস দাস মোটেই পছন্দ করেন না। বলেন, আমাদের স্বাস্থ্যনিবাস ব্যবসার জায়গা দাঁতব্য ভোজনালয় নয়, তুমি তোমার বন্ধুদের সাবধান করে দিও। মিস্টার দাস তার স্ত্রীর এই হুকুম পালন করেছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু রতনবাবুর স্বাস্থ্যনিবাসে আনাগোনা বন্ধ হয়নি এবং এখানকার টোস্ট ও চায়ের প্রতি তার কিছুমাত্র অরুচিও দেখা যায়নি।
রতনবাবুর একটি ঘড়ির দোকান ছিল। আজ তাঁকে দেখেই মিসেস দাসের সেই কথা মনে পড়ে গেল। যাত্রী যে-ঘরে আছে সেই ঘরের একটা বড় ঘড়ি আজ দুদিন বন্ধ হয়ে গেছে, কিছুতেই চলছে না। মিসেস দাস স্থির করলেন, রতনবাবুকে অনেক চা ও টোস্ট জোগান হয়েছে, তার বিনিময়ে তাকে দিয়ে বিনামুল্যে ঘড়িটাকে আজ আবার সচল করে নিতে পারলে বোকামি করা হবে না।
অতএব মিসেস দাস সহাস্যমুখে রতনবাবুকে অভ্যর্থনা করে বললেন, আসুন, আসুন! আমি আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলুম!
মিসেস দাস তাঁকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা করবেন ও তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবেন, রতনবাবুর এমন সৌভাগ্য আর কখনও হয়নি। কাজেই তিনি একেবারে আহ্বাদে-আটখানা হয়ে বললেন, বলেন কি মিসেস দাস! আমায় কি করতে হবে আজ্ঞা করুন।
মিসেস দাস কোনওরকম গৌরচন্দ্রিকা না করেই বললেন, ওপরের ঘরের একটা ঘড়ি খারাপ হয়ে গেছে, আপনি সেটা সারিয়ে দিতে পারবেন?
রতনবাবু মিসেস দাসের সাদর অভ্যর্থনা ও মিষ্ট হাসির অর্থ বুঝতে পারলেন। কিন্তু মুখের ভাবে কিছু প্রকাশ না করেই বললেন, বেশ তো, এ আর এমন শক্ত কি? ঘড়িটা কোথায় আছে?
ওপরের ঘরে। আসুন আমার সঙ্গে। এই বলে মিসেস দাস চেয়ার ছেড়ে উঠে রতনবাবুকে নিয়ে বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মিসেস দাস উপরে উঠে দেখলেন, যাত্রীর ঘরের দরজা বন্ধ। বাইরে থেকেই জিজ্ঞাসা করলেন, ঘরের ঘড়িটা মেরামত করতে হবে। একবার ভেতরে যেতে পারি কি!
ভিতর থেকে আওয়াজ এল–আসুন।
রতনবাবুকে নিয়ে মিসেস দাস ঘরের ভিতরে ঢুকলেন।
ঘরের কোণের চেয়ারে দুই হাতের ভিতরে মাথা রেখে যাত্রী হেঁটমুখে বসেছিল। সন্ধ্যা তখন আসন্ন। মিসেস দাস আলো জ্বালবার চেষ্টা করতেই যাত্রী বলে উঠল, থাক। এখনি আলো জ্বালতে হবে না।..হ্যাঁ, ভালো কথা! আমার লগেজগুলো কাল সকালে পাব কি?
মিসেস দাস বললেন, হ্যাঁ, তা বোধহয় পাবেন। আপনার লগেজগুলো কীসের?
তার ভেতরে রাসায়নিক যন্ত্র আর অনেক রকম ওষুধের শিশি-বোতল আছে। শ্রীপুর নির্জন বলেই আমি এখানে এসেছি। নির্জনে আমি রাসায়নিক পরীক্ষা করতে চাই। কোনওরকম গোলমালই আমি সহ্য করব না।
মিসেস দাসের কৌতূহল আবার জেগে উঠল। তিনি তাড়াতাড়ি বলে ফেললেন, আপনি কি ডাক্তারি করেন?
যাত্রী সে কথার জবাব না দিয়ে আপন মনেই বললে আমি নির্জনে থাকতে ভালোবাসি। আমার চোখ এত খারাপ যে মোটেই আলো সইতে পারি না। সময়ে সময়ে আমাকে ঘরের দরজা-জানলা সব বন্ধ করে রাখতে হয়। অনেক সময় আমি আবার অন্ধকারেই থাকি। এ কথাগুলি দয়া করে মনে রাখবেন।
মিসেস দাস বললেন, নিশ্চয়, নিশ্চয়! আচ্ছা, আমার একটা কথার জবাব দেবেন কি–