কিন্তু খাটের কাছে গিয়ে তিনি যা দেখলেন, তাতে তার বিস্ময় আরও বেড়ে উঠল। তাঁর সমস্ত শয্যা লণ্ডভণ্ড ও বিছানার চাদর ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে এবং তাতেও রক্তের দাগ রয়েছে! এ কী রহস্য!
অবাক হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছেন, এমন সময় পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল কী আশ্চর্য! এ যে পূর্ণ!–পূর্ণবাবু একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলেন, ঘরে তিনি ছাড়া আর জনপ্রাণী নেই! কণ্ঠহীন কণ্ঠস্বর? শ্রীপুরের পাগলামি তাকেও আক্রমণ করল নাকি! ধেৎ!
হঠাৎ একখানা চেয়ারের দিকে তাঁর নজর পড়ল। চেয়ার থেকে ঠিক আধ হাত উপরে শুন্যে একটা ব্যান্ডেজ স্থির হয়ে আছে–আর তাতেও রক্তের দাগ। গোল ব্যান্ডেজ কিন্তু তার ভিতরে কোনও বস্তু বা দেহের কোনও অংশ নেই! এও কি সম্ভব! পূর্ণবাবুর কিছুমাত্র কুসংস্কার ছিল না, কিন্তু এ-দৃশ্য দেখবার পর তারও বুকের কাছটা ছমছম করতে লাগল!
ঘরের ভিতর আবার কে তাকে ডেকে বললে, পূর্ণ! তুমি এখানে!
বিপুল বিস্ময়ে পূর্ণবাবু হাঁ করে রইলেন!
কণ্ঠস্বর বললে, পূর্ণ, ভয় পেও না! আমি হচ্ছি অদৃশ্য মানুষ!
শ্রীপুরের পাগলামি তার শয়ন-ঘরেও ঢুকেছে? না, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখছেন? স্বপ্নের ঘোরেই তিনি যেন বললেন, আঁ?
কণ্ঠস্বর আবার বললে, আমি হচ্ছি অদৃশ্য মানুষ!
নিজের কানকে অবিশ্বাস করেও পূর্ণবাবু বললেন, অদৃশ্য মানুষ? অদৃশ্য মানুষকে দেখতে কি ওই ব্যান্ডেজের মতো?
কণ্ঠস্বর বললে, না। ব্যান্ডেজটা আমার কোমরে বাঁধা আছে। তোমার বিছানার চাদর ছিঁড়ে এই ব্যান্ডেজ তৈরি হয়েছে।
পূর্ণবাবু ভাবলেন, অদৃশ্য মানুষ যদি সত্যিকার মানুষই হয়, তাহলে অত্যন্ত অভদ্র তো! সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়েও তাকে তুমি তুমি বলে কথা কইছে!
কিন্তু এ সবই বাজে ধাপ্পা! ম্যাজিকের ফকিকারিতে তাকে ভোলানো এত সহজ নয়! সামনে এগিয়ে হাত বাড়িয়ে তিনি ব্যান্ডেজটা ধরবার চেষ্টা করলেন। হঠাৎ দু-খানা তপ্ত রক্তমাংসের হাত তার হাত সজোরে চেপে ধরলে সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বর বললে, পূর্ণ, বিশ্বাস। করো। সত্যিই আমি অদৃশ্য মানুষ!
এইবারে পূর্ণবাবুর গায়ে কাঁটা দিলে তিনি চেঁচিয়ে লোকজন ডাকবার উপক্রম করলেন এবং তৎক্ষণাৎ দু-খানা অদৃশ্য হাত সজোরে তার মুখ চেপে ধরলে!
পূর্ণ, বোকামি কোরো না। চাঁচামেচি করলে তোমার ভালো হবে না। আমার গলা শুনেও তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি হচ্ছি বিধু!
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পূর্ণবাবু বললেন, বিধু?
হ্যাঁ, হ্যাঁ–বিধু, অর্থাৎ বিধুভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সিটি কলেজে তোমার সঙ্গে পড়তুম– মনে নেই, দিনে তিরিশ কাপ করে চা খেতুম বলে তুমি আমাকে কেবলই ধমক দিতে? আশ্চর্য, এত শীঘ্র তুমি বন্ধুদের ভুলে যাও!
পূর্ণবাবু আমতা আমতা করে বললেন, বিধু? হ্যাঁ, এখন মনে পড়ছে বটে! কিন্তু অদৃশ্য মানুষের সঙ্গে আমাদের সেই বিধুর কি সম্পর্ক? সে তো অদৃশ্য ছিল না!
না, তখন আমি অদৃশ্য ছিলুম না। এখন হয়েছি।
এও কি সম্ভব? মানুষ অদৃশ্য হতে পারে?
সে আলোচনা পরে করব। আপাতত আমায় কিছু খেতে দাও–আজ তিন দিন আমার পেটে অন্ন যায়নি।
পূর্ণবাবু বললেন, আজ আমার খিদে নেই বলে আমি কিছু খাইনি। আমার খাবার তোমার পাশের টেবিলেই চাপা দেওয়া আছে। ইচ্ছে করলেই খেতে পারো।
নিরাকার বিধুর আর তর সইল না–পূর্ণবাবু অবাক হয়ে দেখলেন তার টেবিলের উপরে রক্ষিত খাবারের থালার ঢাকনিটা হঠাৎ যেন জ্যান্ত হয়ে এক লাফ মেরে টেবিলের আর-এক পাশে গিয়ে পড়ল এবং তারপর খাবারগুলোও জ্যান্ত হয়ে শূন্যে টপাটপ লাফ মারতে শুরু করলে!
খেতে খেতে নিরাকার বিধু বললে, আঃ, এতক্ষণে যেন বাঁচলুম! আমি ঈশ্বরের মতো নিরাকার হয়েছি বটে, কিন্তু ক্ষুধা-তৃষ্ণাকে এখনও জয় করতে পারিনি। ভাগ্যিস দৈবগতিকে তোমার বাড়িতেই এসে পড়েছি!
তোমার দেহ নিরাকার হয়েছে বটে, কিন্তু তোমার দেহের রক্ত তো চর্মচক্ষুকে ফাঁকি দিতে পারে না! ব্যাপার কী? তুমি আহত হয়েছ কেন?
সে অনেক কথা, পরে বলব। আপাতত এইটুকু শুনে রাখো, একটা পাজি লোক আমার টাকা নিয়ে পালাচ্ছিল, তাকে ধরতে গিয়েই, আমার এই বিপদ হয়েছে।…ভাই পূর্ণ, আজ আর আমি কথা কইতে পারছি না–তিন দিন আমি ঘুমোই নি, আমাকে ঘুমোবার একটু ঠাই দাও।
তুমি এই ঘরেই ঘুমোতে পারো, আমি অন্য ঘরে যাচ্ছি।
আর তোমার দু-একটা বাড়তি জামাকাপড় আমাকে দিয়ে যাও।
আচ্ছা।
.
একাদশ । নিরাকারের আত্মকথা
পূর্ণবাবু একখানা আলোয়ান, একটা গরম কোট, একটা ফ্লানেলের শার্ট, একখানা কাপড় ও একজোড়া জুতো এনে দিলেন।
বিধু যখন সেইগুলো পরলে, তখন তার দেহের একটা নির্দিষ্ট গঠন পূর্ণবাবুর চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল–যদিও জামার উপরে তার মুণ্ড, জামার হাতার তলায় তার হাত দুটো এবং হাঁটুর কাপড় ও জুতোর মাঝখানে তার পা-দুটো দৃশ্যমান হল না বলে সে দেহটাকে অত্যন্ত কিম্ভুতকিমাকার দেখাতে লাগল।
বিধু বললে, ভাই পূর্ণ, এইবারে আমি একটু ঘুমিয়ে নেব। বাকি কথা সব কাল সকালে হবে।…হ্যাঁ, ভালো কথা। আমি এখানে আছি একথা তুমি কারুকে বলবে না তো?
কেন?
লোকে আমার কথা টের পায়, এটা আমি পছন্দ করি না! সাবধান, আমার একথা ভ্রমেও ভুলো না!
পূর্ণবাবু সে-ঘর ছেড়ে বেরিয়ে অন্য একটা ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। তার চোখে সে রাত্রে আর ঘুম এল না। একখানা ইজিচেয়ারের উপরে বসে পড়ে তিনি নানা কথা ভাবতে লাগলেন।