স্বাস্থ্যনিবাসের উপরে অদৃশ্য মানুষের আক্রোশ অত্যন্ত বেশি। কারণ, সারাদিনে সে বার চারেক স্বাস্থ্যনিবাসকে আক্রমণ করেছে, সেখানকার একখানা সার্সির কাচও অটুট নেই, এবং কাচের সমস্ত বাসনও চুরমার হয়ে গেছে! স্বাস্থ্যনিবাসের ভাড়াটিয়ারা প্রত্যেকেই পলায়ন করেছে।
খবরের কাগজে এই সব ঘটনার উজ্জ্বল বর্ণনা পাঠ করে শ্রীপুরের বাসিন্দাদের উত্তেজনা, দুর্ভাবনা ও বিভীষিকার আর সীমা রইল না।
কখন কোথায় এই ভীষণ অদৃশ্য মানুষের অদৃশ্য আবির্ভাব ঘটবে, সেই দুশ্চিন্তায় সকলেই তটস্থ হয়ে রইল।
যে-মাঠে বংশীবাবুর সঙ্গে প্রথমে আমাদের চেনাশুনো হয়, সেই ধূ-ধূ মাঠেরই এক নির্জন কোণে একটা ঝোপের ভিতরে তিনি এখন আবার হতাশ ভাবে দুপা ছড়িয়ে বসে ঘন ঘন হাঁপ ছাড়ছেন। এবং মাঝে মাঝে এদিকে-ওদিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে কেন যে তিনি শিউরে উঠছেন অন্য কেউ তার রহস্য বুঝতে পারবে না।
হঠাৎ শূন্যপথে দৈববাণীর মতো এক কণ্ঠস্বর জেগে উঠল,–বংশীবদন, তোমার হাঁপ ছাড়া শেষ হল কি? সন্ধে হতে যে আর দেরি নেই!
বংশীবাবুর বদলে কিছুমাত্র উৎসাহের লক্ষণ দেখা গেল না। অত্যন্ত কাহিল ভাবে তিনি বললেন, আমাকে দয়া করে ছেড়ে দিন আপনার দুটি পায়ে পড়ি!
কণ্ঠস্বর বললে, সে কি হে বংশীবদন! ব্যাঙ্কের কাউন্টার থেকে, রাস্তার লোকের পকেট থেকে আজ কত নোট আর টাকা তোমার পকেটে এসে জুটেছে সেটা হিসেব করে দেখেছ কি? আমার সঙ্গে থাকলে রোজই এমনি আশ্চর্য রোজগার হবে। অর্ধেক তোমার অর্ধেক আমার।
বংশীবাবু দুই হাত জোড় করে কঁচুমাচু মুখে বললেন, আমার আশ্চর্য রোজগারে আর কাজ নেই বাবা! এত রোজগার আমার ধাতে সইবে না! এর চেয়ে গড়ের মাঠের মতন ট্যাক নিয়ে নিশ্চিন্ত প্রাণে ঘুরে বেড়ানো ঢের ভালো। রোজগার করে করব কি, সারা শহর যে আমাকে চিনে ফেলেছে। পথে-পথে পাহারাওয়ালা ঘুরছে আমার গলা টিপে ধরবার জন্যে। আপনি তো অদৃশ্য হয়ে দিব্যি মজায় আছেন কিন্তু আমার? আমার কি হবে?
লোকটা বললে, কেমন করে তাকে দেখিয়ে দেব? সে যে অদৃশ্য মানুষ! সে আমার পিছনে পিছনে তেড়ে আসছে। আমাকে বাঁচাও।
হঠাৎ পাহারাওয়ালার দাড়ি-ভরা গালে চটাৎ করে এক নিরেট চড় এসে পড়ল। গালে হাত বুলোতে বুলোতে হতভম্ব পাহারাওয়ালা দু-পা পিছিয়ে এল। তারপরেই বিস্ময়ে দেখলে, তার সামনের লোকটাকে কে যেন হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কে যে নিয়ে যাচ্ছে তা দেখবার জো নেই!
পাহারাওয়ালা এক লাফ মেরে এগিয়ে গিয়ে দুহাতে লোকটার দুই-পা খুব জোরে চেপে ধরলে, তারপর একদিকে পাহারাওয়ালা ও আর-একদিকে অদৃশ্য মানুষ, এই দুয়ে মিলে টাগ অফ ওয়ার লেগে গেল সেই হতভাগ্য লোকটার দেহ নিয়ে।
গোলমাল শুনে ফাঁড়ির দারোগা বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন, এসব কী কাণ্ড!
পাহারাওয়ালা টানাটানি করতে করতে প্রায় অবরুদ্ধ স্বরে বলে উঠল, অদৃশ্য মানুষ।
যার দেহ নিয়ে টানাটানি করা হচ্ছে সেই লোকটি অর্থাৎ আমাদের বংশীবাবু যাতনায় বিকৃত স্বরে বলে উঠলেন, আমাকে বাঁচাও। আমার দেহ এইভাবে ছিঁড়ে দুখানা হয়ে যাবে!
দারোগা রিভলভার বার করে কয়েকবার গুলিবৃষ্টি করলেন। গুলি অদৃশ্য মানুষের গায়ে লাগল কিনা বোঝা গেল না, কিন্তু বংশীবাবুর দুই হাত থেকে অদৃশ্য মানুষের হাতের বাঁধন ফস করে খুলে গেল!
.
দশম । পূর্ণ-বিধু সংবাদ
রসায়নশাস্ত্রে বিখ্যাত পণ্ডিত শ্রীযুক্ত পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয় শ্রীপুর শহরে বাস করতেন। আজ সারাদিন তাঁর অশান্তির অবধি নেই।
আজ সারাদিন শ্রীপুরের পথে হট্টগোল ও হুড়োহুড়ি চলেছে, তার জন্যে পূর্ণবাবুর সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। সারাদিনই তার কানের ভিতরে এই চিৎকারই বারবার ছুটে এসেছে অদৃশ্য মানুষ। অদৃশ্য মানুষ! অদৃশ্য মানুষ! ওই আসছে! ওই ধরলে!
পূর্ণর্বাবুও বারবার বিরক্তিভাবে নিজের মনেই বলছেন, পৃথিবীতে আবার কি রূপকথার রাজ্য ফিরে এল? অদৃশ্য মানুষ! সারা দুনিয়াটা কি হঠাৎ পাগলা হয়ে গেল?
সন্ধ্যার পরে শহর যখন ঠান্ডা হল ও রাজপথের জনতা কমে গেল, পূর্ণবাবু তখন নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের কাজে বসলেন। রাত যখন দুপুর তখনও তিনি কাজ করছেন একমনে।
আচমকা কি কতকগুলো ভাসা-ভাসা চিৎকার ও রিভলভারের শব্দ তার কানে এসে ঢুকল। কাজ করতে করতে মুখ তুলে পূর্ণবাবু বললেন, আবার কি গাঁজাখোরদের উপদ্রব শুরু হল? কিন্তু রিভলভার ছুঁড়েছে কে? তারপর, আবার তিনি নিজের কাজে মন দিলেন।
অল্পক্ষণ পরেই খুব জোরে তার সদর-দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। তারপর দরজা খোলার ও বন্ধ হওয়ার আওয়াজ এল তার কানে।
চাকরকে ডেকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কে কড়া নাড়ছিল!
চাকর বললে, জানি না হুজুর! দরজা খুলে কারুকে তো দেখতে পেলুম না।
চাকর চলে গেল। পূর্ণবাবু আবার কাজ করতে লাগলেন।
রাত দুটোর সময় তাঁর কাজ শেষ হল। ধীরে ধীরে টেবিলের ধার থেকে উঠে তিনি তার শয়ন-ঘরে প্রবেশ করলেন।
কিন্তু ঘরে ঢুকেই একখানা চেয়ারের তলায় কি-একটা দাগ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, খানিকটা রক্ত! আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন, এখানে রক্তের দাগ এল কেমন করে? কিন্তু একটানা পরিশ্রমের পর তার চোখ তখন ঘুমে জড়িয়ে আসছিল, এসব বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তিনি শয্যার দিকে আবার অগ্রসর হলেন। ঘুমের ঘোরে সে রাত্রে তিনি ক্ষুধার কথাও ভুলে গেলেন।