.
বাইরে তখন বংশীবাবুর চা, রুটি ও ডবল ডিম শেষ হয়ে গেছে।
এমন সময় রতনবাবু শুনতে পেলেন, যাত্রীর ঘর থেকে যেন একটা গোলমালের আভাস আসছে। দিনকাল ভালো নয় বলে তিনিও তাড়াতাড়ি উঠে ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হলেন।
সিঁড়ির সামনে এসেই তিনি শুনলেন, তার খুব কাছেই একটা হাঁচির শব্দ হল। এ হাঁচি তিনি ভোলেননি। শিউরে উঠে তাড়াতাড়ি এক পাশে সরে দাঁড়ালেন।
তার পরেই দেখলেন, সিঁড়ির উপর থেকে একটা পোটলা শূন্যে দুলতে দুলতে নেমে আসছে!
পোঁটলাটা ঠিক যেন হাওয়ায় সাঁতার কাটতে কাটতে বৈঠকখানা-ঘরের দিকে চলে গেল।
ঠিক সেই সময় মিসেস দাস কি-একটা কাজের জন্যে বৈঠকখানা-ঘরের দিকে আসছিলেন। কিন্তু দূর থেকেই উড্ডীয়মান পোঁটলা দেখে তার চক্ষু স্থির ও পা দুটো অচল হয়ে গেল। তার পরেই বাইরের ঘরে একটা অত্যন্ত গোলযোগ উঠল!
সঙ্গে সঙ্গে মানিকবাবু যাত্রীর ঘর থেকে বেগে বেরিয়ে এসে বলে উঠলেন, অদৃশ্য মানুষ! অদৃশ্য মানুষ! ধরো যতক্ষণ ওর হাতে পোটলা থাকবে সবাই মিলে অনায়াসেই ওকে ধরতে পারবে!
রতনবাবু বেগে বৈঠকখানায় প্রবেশ করে দেখলেন, বংশীবাবু পোঁটলাটা কাঁধে করে দ্রুতপদে স্বাস্থ্যনিবাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন! অদৃশ্য মানুষ নির্বোধ নয়, নিজে পোঁটলা নিয়ে যেতে গেলে যে বিপদের সম্ভাবনা আছে, সেটা সে বিলক্ষণই জানে! তাই বংশীবাবুকেই সে পোটলার বাহন করেছে!
রতনবাবুও বংশীবাবুর পিছনে ছুটতে ছুটতে চাঁচাতে লাগলেন, চোর! চোর! পোটলা নিয়ে পালায়! পাকড়াও পাকড়াও!
বেচারী বংশীবাবু! খানিক পরেই তিনি দেখলেন, সারা শ্রীপুর শহরটাই যেন তার পিছনে ভেঙে পড়েছে। সকলেরই মুখে এক কথা–চোর! চোর! পোটলা চোর! ধরো ওকে-মারো ওকে! এসব আপত্তিকর কথা শুনে বংশীবাবু আরও জোরে পা চালিয়ে দিলেন। ছোটবার অসুবিধা হবে বলে তার দাঁতব্য জুতো-জোড়াকেও তিনি পা থেকে খুলে নির্দয় ভাবে বিসর্জন দিতে বাধ্য হলেন।
সকলের আগে আসছিলেন রতনবাবু ও মানিকবাবু। হঠাৎ রতনবাবুর মনে হল, কে যেন তাকে বিশ্রী একটা ল্যাং মারলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি মুখ থুবড়ে পড়ে দু-হাতে মাটি জড়িয়ে ধরলেন।
তারপরেই বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতন মানিকবাবুর টিকলো নাকের উপরে প্রচণ্ড একটা ঘুষি এসে পড়ল। মানিকবাবু দুই চক্ষে অনেকগুলো সর্ষের ফুল দেখলেন–এবং তারপর কি যে হল তা আর তিনি বলতে পারেন না।
আর যারা ছুটে আসছিল, তাদেরও কেউ খেলে কিল, কেউ খেলে চড় এবং কেউ বা খেলে লাথি বা গলাধাক্কা! বেগে ছুটতে ছুটতে আছাড় খেয়ে অনেকেরই হাত-পা-মাথা ভেঙে গেল! বাকি লোকেরা তখন বুদ্ধিমানের মতো যে যেদিকে পারল পলায়ন করলে– এই কথা বলে চাঁচাতে চাঁচাতে–অদৃশ্য মানুষ! অদৃশ্য মানুষ! অদৃশ্য মানুষ আবার ফিরে এসেছে! সকলে সাবধান হও! এই ভয়ানক খবর শুনেই অনেকে নিজের নিজের বাড়ির সদর দরজায় ভিতর থেকে খিল লাগিয়ে দিলে।
শ্রীপুরের সবাই যখন রাজপথে, মিস্টার দাস তখন যাত্রীর ঘরের ভিতরে বন্দি হয়ে আছেন। রাজপথের ও স্বাস্থ্যনিবাসের সমস্ত হট্টগোল ও আর্তনাদ তার কানে এসে ঢুকছে, কিন্তু মিস্টার দাসের ঘর থেকে বেরুবার উপায় নেই কারণ তখন তিনি সদ্যপ্রসূত শিশুর মতোই বস্ত্রহীন! অবশেষে অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি যখন খানকয়েক খবরের কাগজ তুলে নিয়ে কোমরে জড়িয়ে নিজের বস্ত্রের অভাব দূর করবার চেষ্টা করছেন, তখন রতনবাবু আবার হাপরের মতন হাঁপাতে-হাঁপাতে ফিরে এলেন।
ঘরে ঢুকেই রতনবাবু বলে উঠলেন, অদৃশ্য মানুষ! অদৃশ্য ঘুষি! অদৃশ্য লাথি! সমস্ত শ্রীপুরের গতর চূর্ণ হয়ে গেছে!
মিস্টার দাস ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, সে এখন কোথায়?
এতক্ষণ আমরা তার পিছনে পিছনে ছুটছিলুম, কিন্তু এখন আমাদেরই পিছনে পিছনে সে ছুটে আসছে! হাতের কাছে যাকেই পাচ্ছে মেরে তার হাড় গুঁড়িয়ে দিচ্ছে সবাই এখন পালিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছে–অদৃশ্য মানুষ বোধ হয় পাগল হয়ে গেছে!
ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মিস্টার দাস বললেন, সে আর এখানে ফিরে আসবে না তো?
আসবে না কি, ওই এল বুঝি! এই বলেই সাঁতারুরা গঙ্গায় যেমন করে ঝাঁপ খায়, রতনবাবু তেমন করেই মাটির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে একেবারে খাটের তলায় ঢুকে অদৃশ্য মানুষের চেয়েও অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
মিস্টার দাসও কোমরের খবরের কাগজগুলোকে দুই হাতে প্রাণপণে চেপে ধরে দরজার বাইরের দিকে সুদীর্ঘ একটি লম্ফত্যাগ করলেন;–এবং লাফিয়ে তিনি যে কোথায় গিয়ে পড়লেন তা আমরা জানি না, তবে তাকেও আর দেখা গেল না।
.
সারাদিন ধরে শ্রীপুর শহরে যে সব অঘটন ঘটল, চতুর্মুখ ব্রহ্মা চারমুখেও তা বলে শেষ করতে পারবেন না।
রাজপথে কেউ হাঁচলেই চারিদিকে অমনি সাড়া ওঠে ওই অদৃশ্য মানুষ এসেছে! সঙ্গে সঙ্গে সেখানটা মরুভূমির মতন জনশূন্য হয়ে যায়!
বাড়ির ভিতরে লুকিয়ে থেকেও শান্তি নেই! হাওয়ার দাপটে ঘরের দরজা-জানলা যদি হঠাৎ খুলে বা বন্ধ হয়ে যায়, অমনি সবাই হাউ-মাউ করে চেঁচিয়ে ওঠে!
শ্রীপুর ব্যাঙ্কের কাউন্টারের উপরে হাজার কয়েক টাকার নোট নিয়ে একজন কেরানি হিসাব করছিল। আশপাশে আরও অনেক লোক আপন আপন কাজে নিযুক্ত ছিল। এমন সময় দেখা গেল, সকলের চোখের সুমুখ দিয়েই নোটের তাড়া শূন্যপথে উড়ে গেল–ঠিক প্রজাপতির মতন। সবাই রাজপথে ছুটে এল কিন্তু সেই নোট-প্রজাপতিদের আর কোনও সন্ধান পেলে না, কেবল দেখা গেল, একজন ময়লা জামা-কাপড়-পরা লোক খালি পায়ে হন হন করে এগিয়ে যাচ্ছে!