.
নবম । নোট প্রজাপতি
শ্রীপুরের স্বাস্থ্যনিবাসে সকালে-বিকালে চা, টোস্ট, কেক, বিস্কুট ও ডিম প্রভৃতির ব্যবস্থা ছিল। শ্রীপুরের যে-কোনও ভদ্রলোকই কিঞ্চিৎ অর্থব্যয় করলে সেখানে গিয়ে চায়ের তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারতেন। এবং প্রতিদিন সকালে-বিকালেই সেখানে চায়ের তেষ্টা মেটাবার জন্যে অনেক তৃষিত লোকের আবির্ভাব হত।
যাত্রীর অন্তর্ধানের পরের দিন সকালেও স্বাস্থ্যনিবাসের চা-বিভাগে চা-ভক্তদের অভাব হল না।
একটা মস্ত গোল টেবিলের চারিধারে বসে খরিদ্দাররা মাঝে মাঝে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছেন এবং মাঝে মাঝে গতকল্যকার ঘটনা নিয়ে উত্তেজিত ভাবে আলোচনা করছেন। বলা বাহুল্য চা-সভার সভাপতি ছিলেন স্বাস্থ্যনিবাসের মালিক মিস্টার দাস স্বয়ং এবং তাঁর ডাইনে ও বাঁয়ে বিরাজ করছিলেন রতনবাবু ও মানিকবাবু। আসল বক্তা হচ্ছেন তারা তিন জনই, বাকি সবাই শ্রোতা ও উৎসাহদাতা।
বক্তৃতা যখন রীতিমতো জমে উঠেছে, তখন ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন একটি নতুন লোক। তার জামা কাপড় যে হপ্তাকয়েকের মধ্যে রজকের দেখা পায়নি, এ সত্য খুব সহজেই বোঝা যায়। তাঁর ধুলোয় ধূসর তালিমারা জুতো-দুখানির অবস্থাও সন্দেহজনক; কারণ তাদের ভিতরে ভদ্রলোকের পা-দুখানি ঢুকেও আরও খানিকটা বেওয়ারিস জায়গা খালি পড়ে আছে। ভদ্রলোক আসতে আসতে ক্রমাগত পিছনপানে চেয়ে চমকে উঠছেন–যেন তার পিছনে পিছনে আসছে কোনও অদৃশ্য বিপদ!
স্বাস্থ্যনিবাসের খরিদ্দারের এমনধারা হতচ্ছাড়া চেহারা মিস্টার দাস পছন্দ করলেন না। একটু বিরক্ত ভাবে বললেন, এখানে আপনার কী দরকার?
আগন্তুক বললেন, এক পেয়ালা চা আর দু-টুকরো রুটি চাই। গোটাদুয়েক ডিম হলে আরও ভালো হয়।
আগন্তুকের ছেঁড়া পকেটের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে মিস্টার দাস বললেন, দাম চার আনা। আপনাকে, খাবার আগে দাম দিতে হবে।
মিস্টার দাসের ভয়ের কারণ বুঝে আগন্তুক হেসে বললেন আমার পকেট ছেঁড়া বটে, কিন্তু আমার টাকা থাকে ট্যাকে। এই নিন। বলে তিনি ট্র্যাক থেকে একটা টাকা বার করে ঠং করে টেবিলের উপরে ফেলে দিলেন।
মিস্টার দাস অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, আসুন, আসুন, ওই টেবিলের ধারে বসুন। আপনার খাবার এখুনি আসবে। বলেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন, ডাক্তারবাবু, এইবারে সেই ভূতুড়ে লোকটার ঘরে যাওয়া যাক।
মিস্টার দাসের সঙ্গে মানিকবাবু স্বাস্থ্যনিবাসের ভিতরদিকে চলে গেলেন। আগন্তুক টেবিলের ধারে গিয়ে বসলেন। কারুকে বোধহয় বলে দিতে হবে না যে এই আগন্তুকই হচ্ছেন, আমাদের সেই বংশীবাবু।
মিস্টার দাস ও মানিকবাবু যাত্রীর ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখলেন, কালকের সেই তুমুল কাণ্ডের পর ঘরের সমস্ত আসবাব ঠিক সেইভাবেই এলোমেলো হয়ে ছড়ানো রয়েছে। ওলটানো চেয়ার-টেবিল, ভাঙা-চোরা শিশিবোতল ও লণ্ডভণ্ড বিছানা! কেবল যাত্রীর জামা-কাপড়, ব্যান্ডেজ, চশমা ও নকল নাকটা দারোগাবাবু যাওয়ার সময় নিজের সঙ্গে নিয়ে গেছেন।
ঘরের কোণে একখানা পকেটবুক পড়েছিল, সেইখানা তুলে নিয়ে মিস্টার দাস বললেন, এই পকেট বইখানার পাতা ওলটালে লোকটার অনেক কথাই হয়তো জানা যাবে!
মানিকবাবু কি জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় ঘরের দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল।
মিস্টার দাস চমকে উঠে বললেন, ওকি, দরজা খুললে কে?
মানিকবাবু দরজার দিকে চেয়ে খুব সহজ ভাবেই বললেন, বোধ হয় হাওয়ায় দরজাটা খুলে গেল। এতে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই।
মিস্টার দাস বললেন, কালকের ব্যাপারের পর থেকে অমন ভাবে দরজা খুলে গেলেই আমার বুকটা ধড়াস করে ওঠে!
ঘরের ভিতরে একটা চাপা হাঁচির শব্দ শোনা গেল।
মিস্টার দাস বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনি কি এখনি হাঁচলেন?
ঘরের মধ্যে গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল–না, আমি হেঁচেছি। আমাকে আপনারা চেনেন।
মিস্টার দাস ও মানিকবাবু হতাশ ভাবে ও মড়ার মতন সাদা মুখে দুদিকে সরে গিয়ে দেয়ালে পিঠ রেখে দাঁড়ালেন।
কণ্ঠস্বর বললে, মিস্টার দাস, আমার পকেটবুক আপনার হাতে কেন? দিন, ফিরিয়ে দিন।
মিস্টার দাস কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এসে পকেটবুকখানা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
পকেটবুক খানা মিস্টার দাসের হাত থেকে বেরিয়ে শুন্যে উড়ে একখানা চেয়ারের উপর গিয়ে পড়ল।
কণ্ঠস্বর বললে, মিস্টার দাস, আমার জামাকাপড়গুলো কোথায় গেল?
মিস্টার দাস বললেন, পুলিশ নিয়ে গেছে।
কণ্ঠস্বর বললে, আমার আর জামা-কাপড় নেই। তবে আপাতত আপনার জামা-কাপড় পেলেই আমার চলে যাবে। আপনার গায়ের আলোয়ানখানা খুলে মেঝের ওপরে রাখুন। তারপর আপনার জামা, কাপড় আর জুতো সব খুলে ওই আলোয়ানের ভেতরে রেখে দিন। তারপর একটা পোটলা বেঁধে জিনিসগুলো আমার হাতে দিন।
মিস্টার দাস আঁতকে উঠে বললেন, আঁ, সে কি কথা!
কণ্ঠস্বর খুব কর্কশ ভাবে বললে, যা বলছি তাই করুন। দেখতে পাচ্ছেন, আমি অদৃশ্য? আমি যদি ইচ্ছা করি, তা হলে এখনি আপনাদের দুজনকে গলা টিপে, মেরে ফেলতে পারি!
মিস্টার দাস বাধো বাধো গলায় অত্যন্ত লজ্জিত ভাবে বললেন, কিন্তু এ-ঘরে ডাক্তারবাবুর সামনে আমি জামাকাপড় খুলব কেমন করে?
কণ্ঠস্বর বললে, আমি অদৃশ্য বটে, কিন্তু আপনাদের চেয়ে বোকা নই। একবার চোখের আড়ালে যেতে পারলেই আপনি যে এখুনি পুলিশে খবর দিতে ছুটবেন, সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। ওসব চালাকি চলবে না। যা বলছি তাই করুন।.আর মানিকবাবু, ওই বইগুলো গুছিয়ে তুলে আপনিও এই পোঁটলার ভেতরে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করুন।