- বইয়ের নামঃ রহস্য রোমাঞ্চ সমগ্র
- লেখকের নামঃ হেমেন্দ্রকুমার রায়
- প্রকাশনাঃ পত্র ভারতী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই, উপন্যাস, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প
অদৃশ্য মানুষ (উপন্যাস)
প্রথম। অপরিচিত আগন্তুকের আগমন
একটি ছোটখাটো শহর। তার আসল নামটি বলব না। ধরে নাও তার নাম হচ্ছে শ্রীপুর। ছুটির সময়ে নানান দেশ থেকে সেখানে অনেক লোক বেড়াতে আসে। কারণ জায়গাটির জল হাওয়া নাকি ভালো।
পাহাড়ে-শহর। পথে-ঘাটে বেরুলেই আশেপাশে ছোট-বড় পাহাড় দেখা যায়। পাহাড়ে শহরে তখন পাহাড়ে-শীত। মাঝে মাঝে বরফও পড়ে।
বৈকাল। শ্রীপুর শহরে যখন রেলগাড়ি এসে থামল, চারিদিকে তখন কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। সে হাওয়া গায়ে যেন ছুরির ফলার মতন বিধে যায়। বোধ হয় বরফ পড়তে আর দেরি নেই।
একজন যাত্রী ইস্টিশানে এসে নামল। যাত্রীটি জাতে বাঙালি, সেটা তার পরনের কাপড় দেখলেই বোঝা যায়। তার পায়ে ঘোড়তোলা জুতো ও ফুল-মোজা। গায়ের জামা দেখবার জো নেই, কারণ একখানি আলোয়ানে সে গা ঢাকা দিয়ে ছিল। কেবল তার ডান হাতের খানিকটা দেখা যাচ্ছিল, সেই হাতে ঝুলছিল একটা পোর্টম্যান্টো। তার হাতও ছিল দস্তানা-পরা। আলোয়ানের উপর জেগে আছে তার অদ্ভুত মুখখানা–সে-মুখের সবটাই ব্যান্ডেজে একেবারে ঢাকা। সাদা ব্যান্ডেজের ভিতর থেকে জেগে আছে কেবল তার গোঁফদাড়ি আর নাকের ডগাটা। তুলি-চশমা, অর্থাৎ গ দিয়ে সে তার চোখ দুটো পর্যন্ত সকলকার চোখের আড়াল করে রেখেছে। এই রহস্যময় লোকটি যে কে তা আমরা জানি না। এবং যতদিন না তার নাম জানতে পারি ততদিন। পর্যন্ত তাকে আমরা যাত্রী বলেই ডাকব।
শীতে কাঁপতে কাঁপতে ইস্টিশানের বাইরে এসে যাত্রী একটা পথ ধরে এগিয়ে চলল। খানিক দূর অগ্রসর হয়েই একখানা দোতলা বাড়ির সামনে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাড়িখানার দোতলার বারান্দায় একখানা সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে–শ্রীপুর স্বাস্থ্যনিবাস। অল্পক্ষণ সেইখানে দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রী বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলে।
এই স্বাস্থ্যনিবাসটির একটুখানি পরিচয় দরকার। শ্রীপুরে যারা বেড়াতে আসে তাদের অনেকেই এই স্বাস্থ্যনিবাসে আশ্রয় গ্রহণ করে। এর মালিক হচ্ছেন মিস্টার দাস ও মিসেস দাস। তারা বাঙালি খ্রিস্টান। স্বাস্থ্যের খোঁজে যাঁরা এখানে এসে ওঠেন তারা দুজনেই তাদের যত্ন, সেবা ও আদর-আপ্যায়নের ভার নেন–অবশ্য কয়েকটি রূপোর টাকার বিনিময়ে। তারাও এই বাড়ির অন্য এক মহলে বাস করেন।
বাড়ির ভিতরে ঢুকেই একটি বড় হলঘর। সেটি হচ্ছে এখানকার সাধারণ বৈঠকখানা। মিস্টার ও মিসেস দাস প্রত্যহ এইখানে বসেই তাদের অতিথিদের সঙ্গে গল্পগুজব ও আলাপ পরিচয় করেন।
আমাদের যাত্রীটি এই ঘরে ঢুকেই গম্ভীর স্বরে বললেন, আমার একখানা ভালো ঘর চাই!
মিসেস দাস তখন তার কয়েকজন অতিথির সঙ্গে একমনে গল্প করছিলেন। যাত্রীর আকস্মিক প্রবেশে ও গম্ভীর কণ্ঠস্বরে ঘরের সকলেই চমকে উঠল। যাত্রী তার দস্তানা-পরা হাত দিয়ে একখানা একশো টাকার নোট বার করে আবার গম্ভীর স্বরে বললে, এই নিন আগাম টাকা! আমার একখানা ভালো ঘর চাই।
না চাইতেই আগাম একশো টাকা! বিস্ময়ে ও শ্রদ্ধায় মিসেস দাসের প্রাণটা পরিপূর্ণ হয়ে উঠল! কপাল না খুললে এমন অতিথি মেলে না!
মিসেস দাস তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন, আসুন আমার সঙ্গে! আপনাকে বাড়ির সেরা ঘরই ছেড়ে দেব!
মিসেস দাস যাত্রীকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
বাড়ির দোতলায় রাস্তার ধারের বড় ঘরখানিই যাত্রীর জন্যে ছেড়ে দেওয়া হল। যাত্রী সেই ঘরের ভিতরে ঢুকে পোর্ট ম্যান্টোটি একটি টেবিলের উপরে রেখে দিলেন।
মিসেস দাস তার নতুন অতিথিটির সঙ্গে ভালো করে আলাপ জমাবার চেষ্টায় বললেন, আপনি বুঝি বৈকালের ট্রেনে এখানে এসেছেন?
যাত্রী জবাব না দিয়ে মিসেস দাসের দিকে পিছন ফিরে রাস্তার দিকে জানালার গরাদ ধরে দাঁড়াল। তারপর মুখ না ফিরিয়েই বললে, আমার খিদে পেয়েছে। এখুনি কিছু খাবার পাঠিয়ে দিন।
আলাপটি ভালো করে জমল না বলে কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হয়ে মিসেস দাস অত্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মিনিট পনেরো পরে চাকরের সঙ্গে মিসেস দাস আবার ভিতরে এসে ঢুকলেন। যাত্রীকে শুনিয়ে চাকরকে ডেকে বললেন, ভিখ, টেবিলের উপরে খাবারের থালা রাখ!
যাত্রী ঠিক আগেকার মতোই পাথরের মূর্তির মতন জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়েছিল। এবং এবারেও মুখ না ফিরিয়েই বললে, আচ্ছা, আপনি এখন যেতে পারেন!
মিসেস দাস নিজের মনে-মনেই বললেন, লোকটার টাকা আছে, কিন্তু ভদ্রতা-জ্ঞান মোটেই নেই! প্রকাশ্যে বললেন, আপনি চা খান কি?
যাত্রী বললে, মিনিট পনেরো পরে পাঠিয়ে দেবেন।
মিসেস দাস ঘরের ভিতরে আর দাঁড়ালেন না।
মিনিট পনেরো পরে ভিখুর সঙ্গে মিসেস দাস আবার ঘরের ভিতর ঢুকে দেখলেন, যাত্রী জানলাগুলো বন্ধ করে আধা-অন্ধকারে কোণের দিকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে গিয়ে বসে আছে। টেবিলের দিকে চেয়ে দেখলেন, তার জলখাবার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। বললেন, আপনার চা নিয়ে এসেছি।
যাত্রী বললে, চা রেখে যান।
ভিখু চায়ের সরঞ্জাম রেখে টেবিল থেকে জলখাবারের থালাগুলো সরাতে লাগল; মিসেস দাস সেই ফাঁকে যাত্রীকে আর-একটু ভালো করে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভালো করে কিছুই আন্দাজ করতে পারলেন না। যাত্রী তখনও তার মুখের ব্যান্ডেজ তো খোলেইনি, উপরন্তু গায়ের আলোয়ান, হাতের দস্তানা ও পায়ের জুতো-মোজা পর্যন্ত ঠিক সেই ভাবেই পরে আছে। কেবল নিজের ঠোঁটের কাছ থেকে ব্যান্ডেজটি একটুখানি টেনে নামিয়ে রেখেছে–বোধহয় খাবার সুবিধার জন্যে। কিন্তু তার নাকের তলার দিকে চেয়ে মিসেস দাস ঠোঁটের কোনও চিহ্নই দেখতে পেলেন না! তিনি ভাবলেন, আধা-অন্ধকারে বোধ হয় তার চোখের ভ্রম হচ্ছে। তবু তার মনটা কেমন এক অস্বাভাবিক ভয়ে ছাঁৎ-ছাঁৎ করতে লাগল। এ কীরকম রহস্যময় লোক। এ যেন মানুষের চোখের সামনে আসতে চায় না–সর্বদাই নিজেকে সাবধানে লুকিয়ে রাখতে চায়। পৃথিবীর আলো-হাওয়াকে এ যেন পরম শত্রু বলে মনে করে! কে এ! ওর সারা মুখখানায় ও কীসের ব্যান্ডেজ? কোনও দৈবদুর্ঘটনায় ওর মুখখানা কি ভীষণ ভাবে জখম হয়েছে? না, কোনও সাংঘাতিক অস্ত্র-চিকিৎসায় ওর মুখের অবস্থা অমনধারা হয়েছে?