ওলন দেখেছ তো? সেই যে রাজমিস্ত্রীরা ইট সাজাবার সময় ছোট পেতলের লাটুর মতো জিনিসের সাথে সুতো বেঁধে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে দেখে গাঁথুনি সোজা হচ্ছে কিনা। প্রথম দিকে কাঁটাওয়ালা ঘড়ির যখন আবিষ্কার হয়, তখন তার কাঁটা ঘোরাবার জন্যে একটা কাঠিমের গায়ে সুতো পেঁচিয়ে এমনি ওলন ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। ভারি ওলনটা নিজের ওজনেই ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে আসতো; সেই টানে কাঠিমটা ঘুরতো, আর তার সাথে সাথে ঘুরতে ঘড়ির কাঁটাও।
এই রকম ওলনদার ঘড়ি প্রথম কে বা কারা আবিষ্কার করেছিলেন আজ আর তা ঠিকমতো বলার উপায় নেই; তবে এগুলো যে ইউরোপে গিয়েছিল আরব দেশ থেকে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আজ থেকে হাজার খানেক বছর আগে আরবের লোকেরা ইউরোপের লোকের চেয়ে শিক্ষা-দীক্ষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেকখানি এগিয়ে ছিল।
যতদূর জানা যায়, আজ থেকে প্রায় সাতশো বছর আগে সুলতান সালাহউদ্দিন তার বন্ধু বিলেতের সম্রাটের কাছে খুব সুন্দর একটা ওলনদার ঘড়ি উপহার পাঠিয়েছিলেন। তারও পঞ্চাশ বছর পরে সম্রাট প্রথম এডওয়ার্ডের হুকুমে লণ্ডনের পালামেন্ট ঘরের ওপরে ওয়েস্টমিনস্টারের চূড়োয় একটা মস্ত বড় ঘড়ি বসানো হয়; তার নাম দেওয়া হয় ‘বিগ টম’।
ওয়েস্টমিনস্টারের বিরাট উঁচু চূড়ো; তিনশো ষাটটা ধাপ ভেঙ্গে তবে তার। ওপরে উঠতে হতো। পুরো চারশো বছর ধরে বিগ টম ঘড়িটা ওখান থেকে ঘণ্টা বাজিয়েছে, আর সারা লণ্ডন শহরের লোক তাই থেকে সময়ের হিসাব ঠিক রেখেছে। তার পরে ওটাকে সরিয়ে সেখানে ‘বিগ বেন’ নামে আরো বড় একটা ঘড়ি বসানো হয়েছে।
ইউরোপের আর আর বড় শহরেও এমনি চূড়ার ওপর ঘড়ি বসানো শুরু হয়েছে। ফ্রান্সের সম্রাট চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জার্মানি থেকে একজন খুব নামজাদা ঘড়ি কারিগরকে ডেকে পাঠালেন; তার প্রাসাদের চূড়োয় একটা ঘড়ি বসাতে হবে। আট বছর খেটেখুটে ঘড়ি তৈরি হল। তারপর সেই কারিগরকে–নাম তার হেনরি ডি-ভিকঘর দিয়ে, মাইনে দিয়ে সেই ঘড়ির চূড়োতে রেখে দেওয়া হল। তার কারণ তখনকার দিনে এসব ঘড়িতে দিনের মধ্যে কয়েক বার চাবি দিয়ে কাঠিমের ওপর ওলনের সুতোটা জড়াতে হত, আর তাই তার দেখাশোনা করবার জন্যে হরদম ঘড়ির সাথে লোকও রাখতে হত একজন।
আজকালকার চেয়ে আগেকার দিনের ঘড়িগুলো আসলেই ছিল একটু বেয়ারা রকমের জবড়জঙ্গ গোছের। কাটা মোটে একটা, শুধু ঘণ্টার কাঁটা; মিনিটের কাঁটা বলে কিছুই নেই। কিন্তু কী বিরাট সে ঘড়ির ওলন, বিরাট বিরাট তার কল–কবজা-দেখলেই ভয় পাবার কথা।
আমাদের ঘড়িতে আজকাল এক থেকে বারোটা পর্যন্ত দাগ কাটা থাকে। কিন্তু আজকাল রেলের ঘড়িতে যে রকম হিসাব, তখনকার ঘড়িতে ডায়ালটা এই রকম ২৪ ভাগে ভাগ করা থাকত। তারপর তখন ঘড়িতে দিনের শুরু ধরা সন্ধ্যেবেলা থেকে। অর্থাৎ সন্ধ্যের পরে একটা বাজত, তারপর আবার পরের দিন সন্ধ্যেবেলা বাজত ২৪টা। কিন্তু সাধারণ কাজের জন্যে ও-রকম হিসাবে নানান হ্যাঁঙ্গামা। বিকেল পাঁচটায় বেড়াতে বেরুব না বলে যদি ২৩ টা বলতে হয়, তাহলে কেমন শোনায় ছোট সংখ্যা নিয়ে হিসাব করাই লোকের পক্ষে সুবিধে। তাই ক্রমে ক্রমে ২৪ ঘণ্টার বদলে ঘড়ির দাগকে ১২ ঘণ্টায় ভাগ করার ব্যবস্থা হয়; আর দিনের শুরু ধরা হয় সন্ধ্যেবেলার বদলে দুপুর রাতের পর থেকে।
আসলে কিন্তু লোকে জবড়জঙ্গ জিনিস মোটেই পছন্দ করে না; সহজ জিনিসের দিকেই তাদের ঝোঁক। তাই প্রথম দিককার চূড়োর সেই দশ-পনের মণ ওজনের বিরাট বিরাট ঘড়িগুলো থেকে ছোট ঘড়ি তৈরির চেষ্টা চলতে লাগল। কম দামের মধ্যে ছোট ছোট ঘড়ি না হলে সাধারণ লোকে তা ব্যবহারই বা করবে কি করে, আর তাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নাড়াচাড়াই বা করা যাবে কি করে? এসব চেষ্টার ফলে ক্রমে ক্রমে ঘড়ি ছোট হয়ে আজকের দেয়াল-ঘড়ি, টাইম-পিস আর হাত ঘড়ি তৈরি হয়েছে।
নাড়াচাড়া করা যায় এ-রকম একটা ঘড়ি তৈরি করা হয়, ফ্রান্সের সম্রাট ষোড়শ লুই-এর হুকুমে। তাই বলে এটাকেও যেখানে সেখানে ইচ্ছেমতো হাতে করে বয়ে নেয়া চলত না। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিতে হলে তাকে বাক্সবন্দী করে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হত।
তারপর ১৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে প্রথম পকেট-ঘড়ি তৈরি হয়; তৈরি করেন জার্মানির নুরেমবুর্গ শহরের পিটার হেনলীন (Peter Henlein) নামে এক কারিগর। লোকে বলে হেনলীনের ছিল বেজায় বুদ্ধি। এমন খুদে একটা ঘড়ি বানাবার জন্যে কম বুদ্ধি তো আর খরচ করতে হয় নি তাকে; বড় বড় ঘড়ির ওলন আর ওজন-টোজন সব বাতিল করে দিয়ে এবার ঘড়িকে চালাবার জন্যে ব্যবহার করা হল স্প্রিং।
একটা লম্বা স্পিং-কে যতই পেঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করা যাক না কেন সেটা সুযোগ পেলেই সে পাঁচ খুলে ফেলার চেষ্টা করবে। এই স্প্রিং দিয়ে চালানো হল ঘড়ি। ঘড়িতে চাবি দিয়ে স্পিং-কে যত প্যাঁচ ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে, খোলার সময় আবার ততগুলো পাঁচই খুলে আসবে। কিন্তু স্প্রিং-কে তার ইচ্ছেমতো খুলতে দিলে হবে না, তাহলে এক সঙ্গেই সবটা খুলে যাবে। তাই এই স্প্রিং-এর সঙ্গে লাগানো হল গায়ে গায়ে ঠেকানো কতগুলো ধারকাটা চাকা, তারপর তার সাথে যোগ করা হল ঘড়ির কাঁটা। এই সবের ফলে নির্দিষ্ট হারে স্প্রিং-এর প্যাঁচ খুলবে, ঘুরবে ধারকাটা চাকাগুলো; আর তার সাথে ঘুরবে ঘড়ির কাঁটা দুটো।