কিন্তু তার জন্যে মন্দিরে এতগুলো ঘড়া আর সেবায়েত রাখা হয়েছিল কেন সেটা আমাদের কাছে আজও এক রহস্য বলে মনে হয়। এমন হতে পারে যে, মাত্র দু-একটা ঘড়া আর দু-একজন সেবায়েত দিয়েও যে কাজটা চলে যেতে পারে সে বুদ্ধি হয়তো সেকালে ফ্যারাওদের মাথায় খেলে নি। কিংবা হয়তো ঘড়ায় দুধ ভরার জন্যে এতগুলো লোক রাখতে তখনকার রাজরাজড়াদের খুব বেশি খরচ পড়ত না।
সে যাই হোক বিলাসিত্তা করে দুধ ব্যবহার করা হলেও আসলে তো এর কায়দাটা জল-ঘড়িরই। পানির বদলে বালি ব্যবহার করে বালি-ঘড়িরও চলন হয়েছিল। দু’দিক মোটা মাঝখানটা সরু ফাঁদলের মতো দেখতে তার ভেতর দিয়ে ঝির ঝির করে মিহি বালি পড়ে। চাবি দেবার দরকার নেই, ঘড়িটা শুধু উলটো করে বসিয়ে দিলেই হল।
ধীরে ধীরে জল-ঘড়ির আরো উন্নতি হয়েছিল। যাতে ঘণ্টা মাপা যায় তার জন্যে পাত্রের গায়ে দাগ কাটা হল। দাগ কাটার
মধ্যেও অবশ্যি বেশ খানিকটা বুদ্ধি খাটাতে হয়েছে। পাত্রের পানি আগাগোড়া সমান বেগে বেরোয় না। যখন পানি ভরতি থাকে তখন ওপরের বেশি চাপে পানি বেরোয় তাড়াতাড়ি। কিন্তু পানি কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে চাপও কমে, ফুটো দিয়ে পানিও বেরোতে থাকে ধীরে ধীরে; আর সেই জন্যে দাগ কাটতে হয় ছোট-বড় করে।
কিন্তু মনে রেখো হাজার হাজার বছর ধরে আজকের মতো ঘরে ঘরে এসব ঘড়ির চল হয় নি। যে সব রাজ-রাজড়া, বড়লোকের বাড়িতে জল-ঘড়ি থাকত তাদের আবার ঘড়ির পানি বদলাবার জন্যে আলাদা চাকর রাখতে হত। তাই দেশের বেশির ভাগ সাধারণ লোকই দিনের বেলা সময়ের হিসাব রাখত সূর্যের দিকে তাকিয়ে, আর শেষ রাতে মোরগের ডাক শুনে–ঠিক আমাদের গাঁয়ের লোকেরা যেমন আজও করে।
সে যাই হোক, ব্যাবিলন আর মিসর থেকে জল-ঘড়ি তৈরির কায়দা ক্রমে ক্রমে গ্রীসে, তারপর রোমানদের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
আজ থেকে প্রায় দু হাজার বছর আগে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের বেশ খ্যাতি হয়েছিল জল-ঘড়ি তৈরির জন্যে। এই শহরেই প্রথম যে সব বুদ্ধিমান লোক ঘড়ি তৈরির কায়দা বার করেছিলেন তাঁদের হাত থেকে বিদ্যেটা কারিগরদের হাতে যায়। কারিগরদের হাতে এসে জল-ঘড়ির আশ্চর্য উন্নতি হয়। এখানে টেসিবিয়স (Ktesibius) নামে এক কারিগর অদ্ভুত কৌশলের সাথে তখন এক রকমের
ঘড়ি বানিয়েছিল; তাতে নাকি কখনো চাবি দিতে হত না বা পানি ভরতে হত না, অথচ শীত-গ্রীষ্মে ঘড়িটা ঠিক সময় দিয়ে যেত।
এইসব ঘড়ি ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে ভূমধ্যসাগরের তীরে তীরে–ইতালীতে, ফ্রান্সে, আরো নানা দেশে। বাগদাদের বিখ্যাত খলিফা হারুনুর রশীদ ৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের সম্রাট শার্ল মানকে এক আজব রকমের জল-ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। এই ঘড়িতে ঘণ্টা বাজত। ঘড়িতে যতটা বাজত ততগুলো তামার বল বেরিয়ে এসে ঢং ঢং করে পড়ত নিচে রাখা একটা তামার পাত্রে। তাছাড়া ঘড়িতে ছিল বারোটা দরজ; প্রত্যেক ঘণ্টায় একটা করে দরজা খুলে যেত। দুপুর বারোটা বাজবার সঙ্গে সঙ্গে বারোটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসত বারোজন ঘোড়সওয়ার। ঘড়ির চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে তারা দরজাগুলো একে একে বন্ধ করে দিত। রোমান যুগে বক্তার সময় হিসাব এই ঘড়িতে নাকি এমনি আরো নানা করা হত জল-ঘড়ির সাহায্যে
আশ্চর্য ব্যাপার হত। ফ্রান্সের লোকেরা এই ঘড়ি দেখে দারুণ অবাক হয়ে যায়। সে সময়ে ইউরোপের পণ্ডিতরা ধর্মতত্ত্ব, ব্যাকরণ এইসব বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। তখনও ফ্রান্সের বেশির ভাগ গীর্জাতেই ঘণ্টা বাজানো হত সূর্য দেখে; রাতে বড়জোর মোমবাতি বা প্রদীপের তেল পোড়ার হিসাব থেকে।
ইউরোপের বড় বড় পণ্ডিতরা কিন্তু সেই তখন থেকেই মাথা ঘামাচ্ছেন ঘণ্টাকে কি করে আরো ছোট ছোট ভাগে ভাগ করা যায় সেই সব কঠিন কঠিন আঁক-জোখ নিয়ে। এক মস্ত বড় পণ্ডিত ঘণ্টাকে ভাগ করার বুদ্ধি বাতলালেন এই বলে ও এক ঘণ্টা সমান চার কোয়াটার বা চার মুহূর্ত, চারশো আশি ‘আউন্স’ (?) বা পাঁচ হাজার ছ’শো চল্লিশ মিনিট।
মজার ব্যাপার হচ্ছে কাজের বেলা এই সব ভাগ কি করে মাপা যাবে তা নিয়ে তাঁদের বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না; কাগজে-কলমে ভাগ করে দিয়েই তারা খালাস। এর আরো অনেক পরে যখন পেণ্ডুলামওয়ালা ঘড়ি আবিষ্কৃত হয়েছে তখনই কেবল আদতে ঘণ্টাকে মিনিটে, আর মিনিটকে সেকেণ্ডে ভাগ করা গিয়েছে, তার আগে নয়।
.
দুধ–ভাত খাওয়া ঘড়ি
খুব ছোট বেলায় আব্বার টেবিলের ওপর টাইম-পিস ঘড়িটা দেখে আমি ভাবতাম ওটা বুঝি জ্যান্ত, কেমন টিক টিক করে কথা কয়। মা-কে যদি জিজ্ঞেস করতাম, আচ্ছা মা, ঘড়িটা কি খেয়ে থাকে–তাহলে মা রহস্য করে জবাব দিতেন ও কী আবার খাবে; ওটা দুধ-ভাত খায়!
তারপর বড় হয়ে ঘড়িকে খুলতে দেখেছি, নিজে খুলেছি। ওর ভেতর কত যন্ত্রপাতি, যেন একটা দস্তুরমতো কারখানা চলছে, কতো কি ধারকাটা চাকা সব ঘুরছে, সব শামুকের মতো ধীরে ধীরে–মিনিটের আর সেকেন্দ্রে দুটো কাটাকে শুধু ঘোরাবার জন্যে। কিন্তু সব কল-কবজা চলার জন্যেই তো শক্তির দরকার। রেল গাড়ি বা জাহাজ চলে কয়লা আর পানিতে অথবা তেলে; মানুষ চলে নানান রকম খাবার খেয়ে। কিন্তু ঘড়ি আসলে দুধ-ভাতও খায় না বা ওতে পানিও ভরতে হয় না। তাহলে ঘড়ি চলে কি করে?