শুধু তাই না। দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা যে গ্রীনিচের মান মন্দিরের ঘড়ি তাতেও সব দিনেই বারোটা বাজবার সময় সূর্য ঠিক আকাশের মাঝামাঝি থাকে না। মোটামুটিভাবে সূর্য মাঝখানে ওঠলে বারোটা বাজে বছরে চার দিন মাত্র। তার মানে দুনিয়ার সব সেরা ঘড়িও আসলে সূর্যের সময় ধরে চলে না, চলে মাঝামাঝি একটা কাল্পনিক সময় ধরে। সূর্যের সময় ওর সাথে গড়পড়তা ভাবে মিলে যায়। তাই একে বলে গ্রীনিচের গড় সময় বা Greenwich Mean Time (G.M.T.) *।
ভারতের লোকেরা তাদের কাজের সুবিধের জন্যে সারা দেশের একটা সাধারণ সময় ধরে নিয়েছে। তেমনি বাংলাদেশের আর পাকিস্তানের লোকেরা ধরেছে অন্য রকম সাধারণ সময়। বাংলাদেশের সময় পাকিস্তানের সময়ের চেয়ে এক ঘণ্টা এগিয়ে, আর ভারতের সময় থেকে আধ ঘণ্টা এগিয়ে।
আসলে যুগ যুগ ধরে ঠিকমতো সময় মাপার কায়দা-কানুন নিয়ে মানুষের ভাবনা-চিন্তার অন্ত নেই। আগেকার দিনে কত রকম যে যন্ত্র বানানো হয়েছিল, শুনলে অবাক হতে হয়, কাল ছুটির দিন আছে নীলুকে সে সব কাহিনী শোনানো যাবে।
পরদিন মামা তার কথা রেখেছিলেন। দুপুর বেলা খেয়ে-দেয়ে উঠে নীলুকে তিনি যেসব কাহিনী শুনিয়েছিলেন, তার শুধু দরকারি কথাগুলো লিখে ফেললে এই রকম দাঁড়াবে:
সময় মাপার কাহিনী
আগেকার দিনে–ধর আজ থেকে তিন হাজার বছর আগে–লোকে এমন সব অদ্ভুত কাণ্ড করে সময় মাপত যা এখন শুনলে আমাদের দস্তুরমতো হাসি পাবে। যেমন, ধর মঠে উপাসনার সময় ঠিক করবার একটা উপায় ছিল, ধর্ম গ্রন্থের পৃষ্ঠা হিসাব করা।–ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা যাক।
ধর, তুমি ইতিহাসের বইখানা নিয়ে পড়তে বসেছ। এর প্রত্যেকটা পৃষ্ঠা পড়তে তোমার মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট সময় লাগে। তুমি হয়তো বলতে পার, ১০ পৃষ্ঠা পড়া হলে আমি স্কুলে যাব; কিংবা ৫ পৃষ্ঠা আগে মিনি ডাকতে এসেছিল। ঠিক এমনি করে তখনকার দিনে সন্ধ্যে হলে মাঠের একজন সন্ন্যাসী ধর্মগ্রন্থ নিয়ে পড়তে বসত। তারপর একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত এলেই বোঝা যেত রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে-তখন সে উঠে উপাসনার জন্যে ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজিয়ে দিত। আর তাই শুনে মঠের আশে-পাশের অন্য লোকেরাও টের পেতো যে, ভোর হয়ে এসেছে।
কিন্তু বুঝতেই পারছ এ-রকম করে সময় মাপা আসলে খুব সুবিধের ব্যাপার নয়। পড়া কারো তাড়াতাড়ি হয়, কেউ পড়ে ধীরে ধীরে। তাছাড়া সন্ন্যাসী বাবাজী একদিন বইয়ের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল তো-ব্যস!
তার চেয়ে বরং দিনের বেলা সাধারণ কাজকর্মের জন্যে সূর্য দেখে সময় বলা অনেক সুবিধে। তাই পাড়াগাঁয়ে —-যেখানে ঘড়ি নেই, কিংবা লোকে মিনিট গুনে সময় হিসাব করার দরকার মনে করে না সেখানে আজও সূর্য দেখেই সময়ের হিসাব হয়। শহরের লোকেরা যেমন সময়ের চুলচেরা হিসাব করে, গাঁয়ের লোকদের তার দরকার হয় না। তাই তারা সোজাসুজি বলে সকাল বেলা, এক প’র বেলা, দুপুর বেলা, বিকেল বেলা, তারপর সন্ধ্যেবেলা, ব্যস! তাদের খাটুনি যেমন সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত একটানা। সময়ের হিসাবও তেমনি নেহাত সাদামাটা।
আগেকার দিনে আজকের মতো শহর ছিল না, অফিস-আদালত, রেলগাড়ি–উড়োজাহাজ, রেডিও-কলকারখানা কিছুই ছিল না। কাজেই তখন সারা দেশের সময়ের হিসাবই চলত আজকের গাঁয়ের হিসাবের মতো। কিন্তু ক্রমে ক্রমে দেশে যত শহর-বন্দর গড়ে উঠতে লাগল, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়তে লাগল, মানুষের কাছে সময়ের দামও তত বেড়ে উঠল; মানুষ বুঝতে পারল আরো নিখুঁতভাবে সময়ের হিসাব রাখবার ব্যবস্থা করা দরকার।
সূর্যের ছায়া থেকে নিখুঁতভাবে সময় মাপার একটা কায়দা, যাকে বলে সূর্য
ঘড়ি, আবিষ্কৃত হয়েছিল প্রথমে ব্যাবিলনে। আজ থেকে তিন চার হাজার বছর আগে ব্যাবিলনই ছিল দুনিয়ার মধ্যে সেরা শহর। সূর্য ঘড়ি ব্যাবিলন থেকে যায় গ্রীস দেশে। এই ঘড়িতে একটা চ্যাপটা পাথরের ওপর ঘণ্টার সংখ্যাগুলো লেখা থাকত; তার ওপর খাড়া করে বসানো হত একটা তেকোণা লোহার ফক। এই ফলকের ছায়াই দাগকাটা পাথরের ওপর ঘড়ির
কাটার মতো সময় নির্দেশ করত। সূর্যঘড়ি আজকালও আমাদের দেশে দু-একটা দেখতে পাওয়া যায়।
সূর্য-ঘড়ির একটা মুশকিল হল, এতে শুধু যখন আকাশে সূর্য থাকে তখনই সময় দেখা যায়, কিন্তু আকাশে মেঘ করলে কিংবা রাতের বেলা এটা অচল। তখন সময় মাপার জন্যে করতে হয় অন্য ব্যবস্থা।
একটা ফুটো পাত্রে পানি ভরলে পানিটা ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু যত বার পানি ভরা যাক সবটা পানি বেরিয়ে যেতে প্রত্যেক বার একই সময় লাগে। ঠিক এমনি তলায় ফুটোওয়ালা লম্বা সরু পাত্রে পানি ভরে তৈরি হল জল-ঘড়ি। সেও আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, এই ব্যাবিলন শহরেই।
পুরনো বইতে মিসর দেশের একটা অদ্ভুত রকমের দুধের ঘড়ির কথা পাওয়া যায়। প্রাচীন মিসরে নীল নদের ওপর একটা দ্বীপে ছিল ‘ওসিরিস’ দেবতার এক মন্দির। এই মন্দিরে থাকত তলায় ফুটোওয়ালা ৩৬০টা কলস আর প্রত্যেকটা কলসের জন্যে একজন করে সেবায়েত। রোজ ভোরে একজন সেবায়েত তার ঘড়ায় দুধ ভরত, আর ঠিক ২৪ ঘণ্টায় দুধটা যেত তার ফুটো দিয়ে বেরিয়ে। তারপর আর এক পুরোহিত তার ঘড়া ভরত দুধ দিয়ে–এমনি করে চলত সারা বছর।