কিন্তু এই অন্ধকার কি আমাদের দুনিয়াতে চিরদিনই থাকবে? ইচ্ছে করলে এই অন্ধকারকে কি হটানো যায় না?
এসো অতীতের সমস্ত অন্ধকার আর গ্লানির জগৎকে পেছনে ফেলে আমরা আলোর রাজ্যে বিজ্ঞানের রাজ্যে পা দিই।
বিজ্ঞানের রাজ্যে, এই পৃথিবীর বাইরে কোথাও নয়, সেখানে যেতে হলে চোখে স্বপ্নের ফুলিও পরতে হয় না। আমাদের আশেপাশে চারধারে ছড়িয়ে আছে প্রকৃতির কতো বিস্ময়, বিজ্ঞানের কতো বৈচিত্র্য। চোখ খোলা রাখলেই সে-সব দেখতে পাওয়া যায়। রাতের আকাশ তারায় তারায় ছেয়ে যায়। দিনে সূর্যের আলোয় পৃথিবীর বুক ঝলমল করে। বর্ষার দিনে আকাশ ছেয়ে মেঘ করে, অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে; বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে মাঠে কচি কচি ধানের শীষগুলো হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে হেসে ওঠে। রামধনুকের সাতটি রঙ পেখম ছড়ায় আকাশ জুড়ে। এ সব কিছুর মধ্যেই; হ্যাঁ, সব কিছুর মধ্যেই ছড়িয়ে আছে বিজ্ঞানের আশ্চর্য জাদু।
কছির শেখের চোখে এই জাদু সব ধরা পড়ে না–এর অনেক রহস্যই তার অজানা। তাই তার মন কুয়াশায় ঢাকা, তাই তার মনে অন্ধকারের বাসা।
এই সব রহস্যকে জানা, প্রকৃতির নিয়ম-কানুন জেনে তাকে বাগ মানানো, প্রকৃতিকে মানুষের বশ করা–এই হল বিজ্ঞানের কাজ। বশ করা জীবনেরই জন্যে–অন্ধকার, দুঃখ আর বিভীষিকার পুরনো জীবনকে হটিয়ে দিয়ে নতুন জীবনের জন্যে, সুখ, সৌন্দর্য আর প্রাচুর্যের জন্যে।
তাই বিজ্ঞান হল একটা হাতিয়ার জীবনকে, দুনিয়াকে বদলাবার হাতিয়ার।
তাই এসো আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের মশাল জ্বালি। কেননা যেখানেই আমরা এই মশাল জ্বালি না কেন, আর আজ তা যত ছোটই হোক, আমরা তো জানি, এই মশাল একদিন জ্বলে উঠবে দেশের দিকে দিকে; তার উজ্জ্বল আলো গিয়ে ছড়িয়ে পড়বে কছির শেখের মতো আমাদের দেশের হাজার হাজার, লাখ লাখ ভাইবোনের চোখে–আর তাদের চোখের অন্ধকার, মনের অন্ধকার যাবে কেটে।
তখন তারা দেখবে, জীবনকে সুখী আর সুন্দর করার কী অফুরন্ত আয়োজনই রয়েছে এই দুনিয়াতে। বিজ্ঞানের রাজ্যে শুধু বাষ্পের শক্তিই নয়, আছে সূর্যের অপরিমেয় আলো, মাটির সীমাহীন উর্বরতা, আছে হাওয়া আর পানির শক্তি, বিদ্যুৎ আর পরমাণুর শক্তি। আর এ সমস্তই আছে মানুষের সেবার জন্যে। এতদিন কতো অফুরন্ত শক্তিই না ছিল তার নাগালের বাইরে।
সেদিন আমাদের দেশের হাজার হাজার মানুষ যদি বলতে শুরু করে? দুঃখ-গ্লানির অন্ধকারে আমরা আর বন্দী থাকব না, বিজ্ঞানের হাতিয়ার নিয়ে সুখ-শান্তি-আনন্দের নতুন জীবন আমরা কায়েম করব; আর সেই হাজার হাজার মানুষ যদি পরিশ্রম করতে শুরু করে তার জন্যে, তখন? তখনও কি আমাদের জীবনের চারপাশ থেকে এই অন্ধকার না হটে পারবে?
তাই এসো, নতুন জীবনের জন্যে আমরা এক হই। এসো, আমরা বিজ্ঞানের রাজ্যে পা দিই!
ঘড়ি চলে টিক টিক
বাংলাদেশ হবার পর বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করে শেষটায় নীলুরা করাচি থেকে ঢাকায় এলো। হাওয়াই জাহাজে আসতে বেশ লাগছিল তীর। রাশি রাশি তুলো-পেঁজা মেঘের ওপর দিয়ে কত মাঠ-ঘাট নদী-নালা পেরিয়ে, ঝকঝকে আলোমাখা ঢাকা….. ঢাকা।
হ্যাঁ, কতো দিন কতো আশা করে ….. করে …..শেষটায় সত্যি সত্যি তারা ঢাকায় এলো তাহলে! নীলুর মামা কোন এক কলেজের প্রফেসর, প্রথমে তার বাসাতেই গিয়ে ওঠল তারা।
কিন্তু মামা-বাড়ি এলে কি হয়, সব কিছু নীলুর কাছে কেমন যেন ওলট-পালট ঠেকে–মামী নামাজ পড়তে বসেছিলেন। নীলু জানে নামাজ পড়তে হয় পশ্চিম দিকে মুখ করে, কিন্তু তার কাছে মনে হল মামী যেন দক্ষিণ দিকে ফিরে নামাজ পড়ছেন।
কি একটা ব্যাপারে আব্বার হাতের ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে সে আরো অবাক হল। আব্বার হাত ঘড়িতে বাজছে চারটে, কিন্তু মামাদের দেয়াল ঘড়িটা ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজিয়ে দিয়েছে কেন? ঘড়ি কোনটা যে খারাপ হয়েছে জিজ্ঞেস করতে যাবে, এমন সময় তার আব্বা নিজে থেকেই বললেন : ওহ হো; আমার ঘড়ির সময়টা তো ঠিক করে নিতে হবে; এখানকার ঘড়ি আবার আগে আগে চলে কিনা।
নীলু ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসল : তাহলে আসলে এখন কটা বাজে আব্বা, চারটে, না পাঁচটা? আব্বা এ-কথার পরিষ্কার কোন জবাব দিতে পারলেন না। কেমন একটু আমতা আমতা করে বললেন : আসলে ঠিক সময় বলে তো কিছু নেই; লোকে যা বলে তাই হয়। করাচির লোকেরা বলছে এখন চারটে বাজে, তাই তাদের কাছে এখন বিকেল চারটে। ঢাকার লোক বলছে এখন পাঁচটা বাজে, তাই তাদের ঘড়িতে এখন পাঁচটা।
কিন্তু নীলু বুঝতে পারল ব্যাপারটার মধ্যে কি একটা গোলমাল আছে। নইলে একই সময়ে এক এক জায়গার লোক খামাখা ঘড়িতে নিজেদের খেয়ালখুশি মাফিক এক একটা সময় বাজিয়ে রাখবে কেন? তার আব্বাও কথাটা বলেই বিজ্ঞানের প্রফেসর নিলুর মামার মুখের দিকে তাকালেন।
মামা কি একটা মোটা বই পড়ছিলেন। তার পাতা থেকে ঘার তুলে বললেন : আসলে সময়ের এই তফাতটা নেহাতই কল্পনা বা খেয়ালখুশির ব্যাপার নয়; মানুষ দরকারে পড়েই সময়ের নানা রকম নিয়ম-কানুন বানিয়েছে। যেমন ধর, ইস্কুলে পড়ায় সূর্য মাথার ওপর ওঠে বেলা ঠিক দুপুর হলে ঘড়িতে বারোটা বাজবে; সেইটেই হল আদত ঠিক সময়। কিন্তু দুনিয়াটা গোল বলে এর সব জায়গায় একই সময়ে ঠিক দুপুর হয় না। তাই বারোটাও আর সব জায়গায় একই সময়ে বাজে না। ঢাকায় যে সময়ে সূর্য মাথার ওপরে ওঠে কোলকাতায় ওঠে তার ৮ মিনিট পরে, করাচিতে দেড় ঘণ্টারও বেশি পরে। কাজেই দেখ, সারা দুনিয়ার জন্যে একটাই আসল ঠিক সময় বলে কিছু নেই।