এদিকে আমরা জানি, হাওয়ায় অক্সিজেনের পরিমাণ হল মোটামুটি পাঁচ ভাগের এক ভাগ; বাকি প্রায় সবটা নাইট্রোজেন। অর্থাৎ ২০ ঘন ফুট হাওয়ায় অক্সিজেন থাকে ৪ ঘন ফুটের একটু ওপরে।
এবারে দেখা যাক এক ঘণ্টায় রহমান বে-র জন্যে কতটুকু অক্সিজেনের দরকার। সাধারণ একজন লোক অল্পসল্প কাজ করলে ২৪ ঘণ্টায় ২৪ ঘন ফুটের মতো অক্সিজেন ব্যবহার করে। কাজ না করে একদম চুপচাপ পড়ে থাকলে এই পরিমাণ কমে অর্ধেকে এসে দাঁড়ায়।
তা হলে দেখা যাচ্ছে এক ঘণ্টায় রহমান বে-র দরকার ছিল মাত্রই আধ ঘন ফুটের মতো অক্সিজেন। অর্থাৎ তার জন্যে যথেষ্ট বাড়তি অক্সিজেন রয়ে যাচ্ছে এই এক ঘণ্টার শেষে। ইচ্ছে করলে এর পর আরো ঘণ্টা দুই সে অনায়াসেই ঐভাবে কাটিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু তাতে শেষের দিকে বাতাসে অক্সিজেনের ভাগ কম থাকতো বলে তার বিচ্ছিরি রকম মাথা ধরার সম্ভাবনা ছিল। বন্ধ সিনেমা হলে তিন ঘণ্টা বসে থাকার পর বেরোলে যেমন অনেক সময় মাথা ধরে যায় তেমনি।
তাহলে এবার বুঝতে পারলে বন্ধ কবরে কিম্বা চৌবাচ্চার ভেতরে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়ে পুরস্কার বা বাহবা নেবার মধ্যে খুব বাহাদুরির ব্যাপার কিছু নেই। মানুষের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যাপারে আমাদের কতকগুলো সাধারণ জ্ঞানের দস্তুরমতো অভাব রয়েছে বলেই আমরা এগুলো দেখলে, বা এসবের কথা শুনলে এমন অবাক হই।
আর এই জ্ঞানের অভাবের জন্যেই বিশুদ্ধ খোলা হাওয়ার দাম আমরা বুঝি নে। শহরে খোলামেলা ময়দান না রেখে ঘন ঘন ঘড়-বাড়ি উঠিয়ে আমরা শহরকে ঘিঞ্জি করে তুলি। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রেখে হাওয়ার পথ আগলে রাখি। আর গাড়ির ধোঁয়ায় বা কল-কারখানার চিমনির ধোঁয়ায় চারদিকের হাওয়া বিষাক্ত হয়ে ওঠলেও তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করি নে।
দূষিত হাওয়া যে কত মারাত্মক হতে পারে তার একটা দৃষ্টান্ত দিই। ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে লণ্ডন শহর প্রচণ্ড কুয়াশায় ঢেকে যায়। আর এই কুয়াশায় ধোঁয়া এবং ময়লা আটকে গিয়ে শ্বাস নেবার এমন অসুবিধে ঘটায় যে, তাতেই পাঁচ দিনে প্রায় চার হাজার লোক মারা পড়ে।
হয়তো ভাবছ, এত সব হিসাব-পত্তর করে এই কথাগুলো বলার কী এমন দরকার ছিল? হ্যাঁ, ছিল বৈকি! মানুষের শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকবার জন্যে কতখানি হাওয়ার দরকার, হাওয়ায় অক্সিজেনের ভাগ কতখানি থাকা চাই, এসব ব্যাপার খনিতে বা কল-কারখানার বাতাস চলাচলের অবস্থা করার জন্যে খুব কাজে আসে। যুদ্ধের সময় বিষাক্ত গ্যাসের প্রতিরোধেও কাজে লাগে।
দিন রাতের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের হাওয়া না হলে চলে না। হাওয়ায় রয়েছে আমাদের জীবনের প্রধান অবলম্বনঅক্সিজেন গ্যাস। বিশুদ্ধ হাওয়া ছাড়া তাই সুস্থ জীবনের কথা কল্পনা করা যায় না।
আমাদের দেশে ক্রমে ক্রমে নানা রকম শহর বন্দর কল-কারখানা ইত্যাদি গড়ে ওঠেছে। শহরে বন্দরে মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। বাড়ছে কল-কারখানার চিমনি থেকে বেরোনো ধোঁয়া, দৃশ্য আর অদৃশ্য ধুলো, হাওয়ায় নানা রকম বিষাক্ত গ্যাস। আর তেমনি বাড়ছে আমাদের চারপাশের হাওয়া দূষিত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। কাজেই দেশের সব মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যে এসব কথা ভাবতে হবে বৈ কি!
আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
মাঠে যত দূর চোখ যায় কেবল সবুজের বন্যা। কচি কচি ধানের চারাগুলো মাথা তুলেছে। সারা মাঠ জুড়ে কে যেন বিছিয়ে দিয়েছে বিরাট একখণ্ড সবুজ মখমল। মাঠভরা ফসলের দিকে তাকিয়ে কৃষাণের বুক আনন্দে আশায় গর্বে ভরে যায়।
কিন্তু এ আনন্দ তার বেশি দিন টিকে না। আকাশে এক ফোঁটা মেঘের দেখা নেই; ছোট ছোট ধানের চারাগুলো বৃষ্টির অভাবে কুঁকড়ে কালো হয়ে ওঠে; বৈশাখের আগুন-ঢালা রোদের তাতে সারাটা মাঠ ঝলসে যায়। বৃষ্টির জন্যে মানুষ তখন আকুল হয়ে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাতে থাকে। কেননা এই অনাবৃষ্টি আকালেরই পূর্বাভাস, সারা বছরের খোরাক রয়েছে তার ওই মাঠের বুকে।
ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যের পর আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে ছড়া কেটে কাপড়ের খুঁটে গেরো বাধে। অসহ্য গরম পড়লে পাড়াময় ঘুরে চাল তোলে; একজনকে সাজিয়ে সুর করে ছড়া কেটে তার মাথায় ঘড়ায় ঘড়ায় পানি ঢালে; তারপর বৃষ্টির জন্যে মাটিতে গড়াগড়ি যায়। তবু বৃষ্টি হয়তো নামে, হয়তো বা নামে না।
এখনকার মতো মানুষের যখন এতটা বুদ্ধি-শুদ্ধি হয় নি তখন সেই আদিম যুগের মানুষেরা মনে করতো বৃষ্টির বুঝি একটা দেবতা আছে, তিনি যখন কোন কারণে অসন্তুষ্ট হন তখনই অনাবৃষ্টি আর আকাল নামে। বৃষ্টি যে কখন কেন হয় সে সব কিছুই তারা বুঝত না; শুধু জানতো, বৃষ্টি নামলে ফসল ফলে, নইলে চাষ বাস সব নষ্ট হয়ে যায়। তাই বৃষ্টি না হলেই দল বেঁধে নেচে, গান গেয়ে তারা বৃষ্টির দেবতাকে খুশি করবার চেষ্টা করতো। সেই সব আচার অনুষ্ঠানের রেশ আজো মানুষের মধ্যে এখানে সেখানে কিছুটা রয়ে গিয়েছে।
কিন্তু আজ তো বৃষ্টি কি করে হয় তা আমরা জানি। সাগর থেকে বাষ্প হয়ে ওঠা পানির ঝাঁপি নিয়ে মেঘ উড়ে আসে। পাহাড়ের বাধা পেয়ে আকাশের ওপরে উঠতে উঠতে ঠাণ্ডা হয়ে বাতাসের ধুলোর কণায় বৃষ্টির ফোঁটা জমে। তারপর সেই ভারি হয়ে ওঠা ফোঁটাগুলোকে মেঘ যখন আর ধরে রাখতে পারে না তখনই নামে বৃষ্টির ধারা।