আর এই দৈত্যের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোই বা যায় কি করে? কি করে অন্ধ প্রকৃতিকে মানুষের বশে আনা যায়?
তারও জবাব ইল এ যুগের জীয়নকাঠি সেই বিজ্ঞানই। বিজ্ঞানের আলোতে যখন প্রকৃতির রহস্য ভেদ করা যাবে, তখনই কেবল এই সব দৈত্যের প্রাণ-ভোমরাকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে ফেলা সম্ভব হবে। আর এই সব দৈত্যের প্রাণভোমরাকে পিষে মারলেই মায়ার জাল ছিন্নভিন্ন হবে, নতুন জীবনের আনন্দে হেসে উঠবে সমস্ত প্রকৃতি।
তাই এসো আমরা বিজ্ঞানের জীয়নকাঠি নিয়ে প্রকৃতির রহস্যের ঝাঁপি খুলি।
এসো সবাই মিলে এক জোট হয়ে আমাদের চারপাশের চেনা-জানা প্রকৃতির রহস্যের জালকে ভেদ করি।
হাড় কাঁপানো শীতে
জামীল আর রুবা। ভাই আর বোন। বয়সের তফাত ওদের মোটেই এক বছর। জামীল ছয়, রুবা পাঁচ। তাই দিনরাত খেলাধুলো সব এক সাথে। কখনো সে। খেলা গরু নিয়ে হোক না খেলনা গরু অথবা জ্যান্ত বাচ্চা গরু। কখনো হাঁড়ি-কুড়ি বা পুতুল নিয়ে। আবার কখনো বা খেলছে তারা ব্যাট আর বল নিয়ে।
কিন্তু গোল বাধে ওদের রাতে শুতে গিয়ে। রুবা কাঁদবে : আব্বা, ভাই সবটা লেপ টেনে নিয়েছে। জামীল চেঁচাবে? আম্মা, রুবা আমাকে চিমটি কেটেছে। লেপ যে কার ভাগে ঠিক কতখানি থাকবে, সে প্রশ্নের আর কিছুতেই মীমাংসা হয় না।
অথচ সকাল বেলা উঠলে দেখ যাবে জামীল একপাশে পড়ে আছে হাত-পা দুমড়ে গোল হয়ে, রুবা আরেক পাশে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে; মাঝখান থেকে লেপ যে কোথায়, তার কোন পাত্তা নেই। হয়তো বিছানাতেই নেই সে লেপ। কোন ফাঁকে নিচে মেঝেয় পড়ে গেছে।
তোমাদের বাড়িতে কি কখনো এমন হয়? বাচ্চা বা জোয়ান বা বুড়ো ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে গোল হয়ে আছে, এমন দৃশ্য কি দেখেছ কখনো? বাড়িতে অথবা রাস্তার ধারে? মানুষ কিংবা অন্তত কুকুর বা বেড়াল?
আচ্ছা, বলতে পার ঠাণ্ডা পেলে মানুষ এমন কুঁকড়ে গোল হয়ে যায় কেন? হয়তো কেউ কেউ পারবে বলতে। কিন্তু অনেকেই পারবে না।—আচ্ছা, শোন। ব্যাপারটা।
আমাদের শরীরের মধ্যে অনবরতই তাপ তৈরি হচ্ছে। আমরা যে সব খাবার দাবার খাই তা থেকেই তৈরি হয় এই তাপ। কিন্তু বাইরে ঠাণ্ডা থাকলে তা এই তাপকে টেনে নেয়। এভাবে তাপ হারানো নির্ভর করে অনেকটা শরীরের গড়ন বা আকারের ওপরে। তার কারণ একই পরিমাণ জিনিস বিভিন্ন আকারের হলে তার ওপরকার আয়তন কম-বেশি হয়।
গোলমতো জিনিসের চেয়ে লম্বা, সরু বা পাতলা জিনিসের আয়তন বেশি। যেমন ধর, এক দলা ময়দা নিলে; তার ওপরকার আয়তন কতটাই বা! কিন্তু সেটাকে বেলে রুটি বানালে তার ওপরকার আয়তন যায় অনেক বেড়ে। ওপরকার আয়তন যত বেশি হবে, শরীর থেকে তাপও হারাবে তত বেশি। এবার তো বুঝলে, হাড় কাঁপানো শীতে শরীরের তাপ ধরে রাখার জন্যে মানুষ বা জন্তু-জানোয়ার কেন কুঁকড়ে গোল হয়ে থাকে?
এরই জন্যে খুব শীতের দেশ আর গরমের দেশের জীবজন্তুর চেহারার মধ্যেও পার্থক্য দেখা যায়। যেমন ধর, খরগোশের কান খুব লম্বা বলেই আমরা জানি। খরগোশের নামও হয়েছে এই জন্যেই। ফারসিতে ‘খর’ মানে বড়, আর ‘গোশ’ হল কান। কিন্তু এমন লম্বা পাতলা কান যদি বেরিয়ে থাকে খুব শীতের দেশে, তাহলে তাপ হারিয়ে সে কান জমে বরফ হয়ে যাবে। তাই খুব উত্তরে ঠাণ্ডা মেরুর দেশে খরগোশের কান হয় ছোট আর পুরুযাতে কান থেকে তাড়াতাড়ি তাপ বেরিয়ে যেতে না পারে।
শীতের দেশের শেয়ালের কানও গরমের দেশের শেয়ালের কানের তুলনায় ছোট। অথচ মরুভূমিতে যে সব শেয়াল থাকে তাদের কান আবার লম্বা; তাতে তাদের শরীরের বাড়তি তাপ বেরিয়ে যেতে সুবিধে হয়।
আকার বা গড়ন ছাড়াও কোন জিনিস বড় বা ছোট তার ওপরেও তাপ হারানো অনেকটা নির্ভর করে। বড় জিনিসের মধ্যে তাপ থাকবে বেশি, ছোট জিনিসে কম। তাই বড় জিনিসের তাপ হারাতে সময়ও বেশি লাগবে।
মনে কর গরম দুধের হাঁড়ি থেকে খানিকটা দুধ ঢালা হল একটা চায়ের পেয়ালাতে। পেয়ালার দুধ আগে ঠাণ্ডা হবে, না হাঁড়ির দুধ? তোমরা নিশ্চয়ই বলবেঃ
হাড় কাঁপানো শীতে কেন? পেয়ালা ছোট, তাতে দুধ কম–সেই দুধ তো আগে ঠাণ্ডা হবে। এই জন্যে একই জন্তু সাধারণত গরম দেশের চেয়ে শীতের দেশে বড় আকারের হয়। গরম দেশে যে সব ভালুক দেখা যায়, তাদের চাইতে মেরু অঞ্চলের ভালুক আকারে সচরাচর অনেক বড় হয়। মেরু দেশের ভালুকের কখনো কখনো বিশ মণ পর্যন্ত ওজন হয়।
শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্যে ঠাণ্ডার দেশের জীবজন্তুর চামড়ার তলায় থাকে খুব পুরু চর্বির স্তর। এই চর্বি ঠাণ্ডাকে ঠেকিয়ে রাখে। চর্বি পুড়ে দেহে তাপও সৃষ্টি হয়।
শীতকালে আমরা রাতে যে তুলোর লেপ গায়ে দিই, বলতে পারো তাতে শরীর গরম থাকে কি করে? তুলোর ফাঁকে ফাঁকে আটকে থাকে হাওয়া। আর এই হাওয়ার মধ্যে দিয়ে তাপ সহজে পালিয়ে যেতে পারে না। তাই লেপের আবরণ শরীরের তাপকে বন্দী করে রাখে। কথা কিন্তু তুলোর মতো অতটা হাওয়া আটকে রাখতে পারে না। তাই কাঁথা দিয়ে লেপের মতো অত ভালো করে শীতও ঠেকানো যায় না।
এস্কিমোদের ছবিতে দেখবে, তাদের পোশাক খুব ঢোলা রকমের। অর্থাৎ এমন করে তৈরি যাতে তার মধ্যে অনেকখানি হাওয়া আটকে রাখা যায় তাহলেই শরীরের তাপ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে পারবে না।