একটা কাঁচের জিনিস নিয়ে গরম দাও! দেখবে, কেমন গলে গলে নরম হয়ে যাচ্ছে ইচ্ছেমতো বাঁকানো যায়; টেনে লম্বা করা যায়। কাঁচের জিনিস তৈরির কারখানায় যাও। সেখানে দেখবে, লোকেরা লোহার নলের ডগায় কী সুন্দর তাল তাল গলা কাঁচ নিয়ে ইচ্ছেমতো ফোলাচ্ছে, দোলাচ্ছে, চাপ দিয়ে ছাঁচের ভেতর থেকে বের করে আনছে বোতল, শিশি, চিমনি, পেয়ালা–এমনি কত কী।
আদতে সব প্লাস্টিকই এই রকম-বেশ কাদা কাদা হবে। কিন্তু খালি কাদা হয়ে থাকলেই তো আর চলবে না তারপর যদি আবার শক্ত না হল তাহলে আমরা অমন চমৎকার চমৎকার প্লাস্টিকের জিনিস পাব কি করে?
তাহলেই বুঝতে পারছ প্লাস্টিককে শুধু কাদা থাকলেই চলবে না। কোন রকমের দরকারি কাজে লাগাতে হলে তাকে আবার সময় মতো শক্ত হতে হবে। এক রকম স্নাস্টিক হচ্ছে কাঁচের মতো। আগুনের তা দিয়ে গরম কর, কাদা কাদা চটচটে হবে; ঠাণ্ডা কর, দেখবে কোন এক জাদুর জোরে একেবারে লোহার মতো শক্ত হয়ে গিয়েছে। যতক্ষণ গরম ছিল খুশিমতো কুমোরের চাকে মাটির তালের মতো তাকে দিয়ে যে কোন জিনিস গড়া যেত। কিন্তু শক্ত হবার পরে আঙ্গুল দিয়ে হাজার টিপেও আর তাকে নরম করা যাবে না। আবার আগুনে তাপ দাও–দেখবে, কেমন সুড়সুড় করে গলতে আরম্ভ করছে।
সেলুলয়েড, পলিইথাইলিন (বাজারে যার স্বচ্ছ পাত দিয়ে নানা রকম সওদা মোড়া থাকে), পলিস্টাইরিন, নাইলন–এগুলো হল এই জাতের প্লাস্টিক। গরম আর চাপের কাছে এরা একেবারে কাবু; যতবার গরম আর চাপ দেবে ততবারই নরম হবে।
এগুলোকে সবসুদ্ধ এক দলে ফেলে আলাদা করে রাখা যায়। এদের একটা কটমটে ইংরেজি নাম আছে–নামটা হল ‘থামোপ্লাস্টিক’। থামো-মিটার দেখেছ তো? থামো কথাটার মানে হল তাপ। অর্থাৎ কিনা যে প্লাস্টিকের ওপর গরম বারে বারেই খাটানো যাবে।
এছাড়া আর এক জাতের প্লাস্টিক আছে এগুলোর মেজাজ আবার একটুখানি চড়া। পয়লা বার গরম করার পর চাপ দিলে ঠিকঠাক গলবে, চট চটে হবে–তারপর ছাঁচের মধ্যে শক্তও হবে। কিন্তু একবার শক্ত হয়ে গেলে যতই চাপ দাও, সাধ্য-সাধনা কর, কিন্তু এদের আর কোন মতেই গলাতে পারবে না। এদিক থেকে এরা একে বারে অনড় অটল।
এগুলোর ইংরেজি নাম হচ্ছে ‘থামোসেটিং’অর্থাৎ যার ওপর তাপ মাত্র একবার খাটানো যায়। এজাতের প্লাস্টিকও আমরা হরদমই দেখি। যেমন বেকেলাইট, মেলম্যাক। বেকেলাইটের রেডিও সেট, বেকেলাইটের সিগারেট কেস আরো কত কী; মেলম্যাকের পেয়ালা-বাসন আজকাল আমাদের দেশেও তৈরি হচ্ছে। এগুলো সাধারণ গরমে ফাটে না। হাত থেকে পড়লেও ভাঙ্গে না। ভারি সুবিধে!
কি, প্লাস্টিক কাকে বলে এবার বুঝতে পারলে তো?
টুনু অবাক হয়ে সেঁক গিলছে? এ কিন্তু ভারি অদ্ভুত; প্লাস্টিকের ভেতর এত কিছু আছে জানতাম না তো! থামোপ্লাস্টিকগুলো কেমন মজার; যতবার খুশি ভাঙ্গো আর গড়ো–গলাও আর ঠাণ্ডা কর–সব নিজের খেয়ালখুশি মতো। আর এই থামো-সেটিং না কি নাম বললে, ওগুলো তো ভারি বেয়াড়া; একবার শক্ত হলেই আর নরম হবে না?
ঃ আরে আসল রহস্য তো ওখানেই। বড় বড় মাথাওয়ালা বিজ্ঞানীরা তো প্রথমটায় বুঝতেই পারেন না, এমন ধারা কেন হয়। তারপর অনেক রকম পরীক্ষা করতে করতে তারা দেখেন, প্লাস্টিকের ভেতরে সে আবার এক মজার রাজ্য।
সব জিনিসের একেবারে গোড়ার কথা যে অণু আর পরমাণু এক সঙ্গে মিলে মিশে এক একটা করে অণু তৈরি হয়। প্লাস্টিক জাতের জিনিসের ভেতর অণুগুলো হয় বড়সড় আর লম্বা গোছের, বেশ থোকে থোকে সাজানো থাকে। তাই অন্য সব সাধারণ জিনিস গরম করলে পর তার খাটো খাটো অণুগুলো যেমন একেবারে আলাদা হয়ে জিনিসটা একদম গলে যায়, প্লাস্টিকের বেলায় তা হতে পারে না।
গরম পেলে থোক-বাঁধা শেকলের মতো লম্বা অণুগুলো একটু একটু করে পাশ কাটিয়ে সরতে থাকে; আর তাই প্লস্টিক অমন কাদা কাদা হয়ে দাঁড়ায়। থার্মোপ্লাস্টিককে তাপ দিলে প্রত্যেক থোকসুদ্ধই সরে, থোকের বাঁধন শুধু একটু আলগা হয় মাত্র। যতবার তাপ দেওয়া যায় ততবারই প্লাস্টিক এই ভাবে নরম হতে থাকে। কিন্তু থামোসেটিং জাতের প্লাস্টিককে একবার তাপ দিলেই থোকগুলো সব ভেঙ্গেচুরে অণুগুলো বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। তাই পরে তাপ দিয়েও তাদের আর নরম করা যায় না।
প্লাস্টিক জাতের জিনিসের রহস্য জানতে পারার পর বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, তাই তো এসব কথা জেনে নিয়ে এখন তো আমরা ইচ্ছেমতোই প্লাস্টিকের জিনিস বানাতে পারি; দুনিয়াতে এত রকমের ফেলনা জিনিস রয়েছে, সেগুলো থেকে যদি দরকারি জিনিস বানিয়ে তাদের কাজে লাগানো যায় তাহলে মন্দ কি!
বিজ্ঞানীদের সে চেষ্টা সফল হয়েছে। আজকে তাই আমরা বাজারে হাজার রকমের প্রাস্টিকের জিনিস দেখতে পাই। শুধু এক আমেরিকাই বছরে বহু হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিকের জিনিস তৈরি করে। আমেরিকায় আজকাল যত কাপড়-চোপড় তৈরি হয় তার প্রায় অর্ধেক তৈরি হয় প্লাস্টিক জাতীয় আঁশ থেকে বাকিটা তুলো, পশম এইসব থেকে। সেখানে স্কুলের ছোট ছোেট ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত প্লাস্টিকের তৈরি খেলনার ছাঁচ দিয়ে নানা রকমের প্লাস্টিকের জিনিস তৈরি করে।
এই সব প্লাস্টিক কিসে থেকে তৈরি হয় সে শুনলে তো আরো অবাক হবে। প্লাস্টিক তৈরির প্রধান উপকরণ হল কয়লা, হাওয়া, পানি, চুনাপাথর আর নুন। অবশ্য সব সময় প্লাস্টিকের জন্যে এর সবগুলো দরকার হয় না। যেমন ধর ‘পলিইথাইলিন’ তৈরি হয় শুধু কয়লা আর পানি থেকে। ‘নাইলন’ তৈরি করতে চাই হাওয়া, কয়লা আর পানি। মেলম্যাক তৈরি করতে লাগে কয়লা, পানি আর চুনাপাথর।