বছরে সারা দুনিয়ায় চার-পাঁচ কোটি টন নুন খরচ হয়, অর্থাৎ মাথাপিছু প্রায় আট-ন’ কেজি করে পড়ে। এর সবটা যে খাওয়ার জন্যে খরচ হয় তা কিন্তু নয়।
খাওয়া ছাড়াও নুন যে আমাদের রোজকার জীবনে আরো কত শত কাজে লাগে তা আর বলে শেষ করা যায় না। জুতোর চামড়া পাকা করতে; কাঁচ, সাবান, কাগজ, বরফ, রুটি, কৃত্রিম রবার, প্লাস্টিকের জিনিস তৈরি করতে; মাছ-মাংস, ফলমূল জমিয়ে রাখতে; এ ছাড়া নানা রকম রাসায়নিক জিনিস আর ওষুধ-পত্র তৈরি করতে আজকাল নুন ছাড়া চলে না।
বরফের সাথে নুন মেশালে বরফের তাপমাত্রা আরো কমে যায়। তাই পানি থেকে বরফ তৈরি করার জন্যে বরফের কারখানায় নুন ব্যবহার করা হয়। একই ভাবে আইসক্রীম জমাবার জন্যেও নুন মেশানো অতি ঠাণ্ডা বরফ কাজে লাগে।
আমাদের দেশে অনেকে নুন আর তেল মিশিয়ে দাঁত মাজে। ডাক্তাররা বলেন এটা দাঁতের পক্ষে ভাল, কেন না নুন জীবাণু নষ্ট করে। আর সেই জন্যেই মাছ-মাংস বা বাটা মসলায় নুন মিশিয়ে রাখলে তা সহজে নষ্ট হয় না। নুন জীবাণু নষ্ট করে। বলে গরম পানিতে সামান্য নুন মিশিয়ে গড়গড়া করলে গলার ব্যথা তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যায়।
নুনের খনি থেকে দু’রকমভাবে নুন তোলা যায়। এক হচ্ছে কয়লা খনির মতো খনির ভেতরে নেমে কেটে কেটে নুন তোলা। তফাত কেবল এই যে, কয়লা খনির ভেতরটা হল কুচ কুচে কালো, আর নুনের খনির ভেতরটা ধবধবে সাদা। দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে : খনির ভেতরে লম্বা নল দিয়ে পানি ঢুকিয়ে দিলে নুন গলে যায়; তখন সেই পানিকে আবার পাম্প করে ওপরে তুলে রোদে শুকিয়ে নিলেই নুন পাওয়া গেল। এতে খনির ভেতরে আর মানুষ নামবার দরকার হয় না।
খাবার নুনের একটা বৈজ্ঞানিক নাম আছে সেটা হল সোডিয়াম ক্লোরাইড। অর্থাৎ সোডিয়াম ধাতুর একটা পরমাণু আর ক্লোরিন গ্যাসের একটা পরমাণু (এ দুটোর একটাও কিন্তু মানুষের খাবার নয়) হাত ধরাধরি করে হয় একটা নুনের অণু। সোডিয়ামের ল্যাটিন নাম ন্যাট্রিয়াম; সাংকেতিক চিহ্ন Na। আর ক্লোরিনের সাংকেতিক চিহ্ন Cl। তাই বিজ্ঞানীরা সোডিয়াম ক্লোরাইডকে সংক্ষেপ করে লেখেন NaCl। কথাটা শিখে রাখো, সময়মতো বন্ধুবান্ধব ভাই-বোনকে শুনিয়ে অবাক করে দিতে পারবে।
ফেলনা থেকে খেলনা
হারুন হচ্ছে এমন ধরনের ছেলে যারে রাস্তায় বেরুলেই অন্তত সাত বার আফসোস করতে হবে। হয়তো গরমের দিনে ডাবের দোকানের সামনে ডাবের খোলার কাড়ি জমে রয়েছে। দেখে হারুন জিব আর তালুতে এক রকম অদ্ভুত শব্দ করে বলবে? আঃ এগুলোকে কী চমৎকার কাজে লাগানো যেত। দেশের কত জিনিস নষ্ট হচ্ছে এমনি করে।
এমনকি হারুনের রাস্তায় বেরোবারও দরকার করে না। বাড়িতে হয়তো কাঠের গুঁড়ো দিয়ে চুলোয় জ্বাল দেওয়া হচ্ছে, কিংবা আখ খেয়ে কেউ ছোবড়া ফেলে রেখেছে। হারুন দেখলে খামখা খানিকটা মেজাজ দেখিয়ে দেবে? বলি এগুলো কি এমনি করে নষ্ট করবার জিনিস?–কত কাজ হয় এসব থেকে!
আসল ব্যাপারটা হল হারুনের নাকি একটা প্লাস্টিকের ফ্যাক্টরি খোলার ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে; সেখানে সে নানা রকম ফেলনা জিনিস থেকে চমৎকার চমৎকার খেলনা তৈরি করবে। খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু ছাড়া এসব গোপন খবর অবশ্য সে বিশেষ কারো কাছে বলে না।
প্লাস্টিকের কথায় হারুন একেবারে পঞ্চমুখ। কথায় কথায় বলবে? দেখ প্রাস্টিকের জিনিস আজ আমাদের জীবনের চারদিক একেবারে ঢেকে দিয়েছে। দাঁত মাজবার যে ব্রাশটা তার আগা গোড়াই প্লাস্টিকের তৈরি; চুল আঁচড়াবার চিরুনি, লিখবার কলম, চশমার ফ্রেম, টেলিফোনের হাতল, খোকার খেলনা, এ সবই প্লাস্টিকের। তার ওপর আজকাল আবার প্লাস্টিকের জুতো-মোজা, খাবার বাসন, কাপ-প্লেট, চামচ, এমন কি নকল দাঁত-চোখ-নাকও বেরিয়েছে। কত রকমের কল-কবজা যন্ত্রপাতির অংশ যে আজ প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই।
সেদিন বৈঠকখানায় বসে গল্প করতে করতে কি করে একটা চায়ের কাপ ভেঙ্গে গিয়েছে। টুলু হঠাৎ বলে ওঠল : কি হারুন, এ পেয়ালাটাও তো আশা করি তোমার প্লাস্টিকের তৈরিই ছিল!
টুনু মাঝখান থেকে ফোঁড়ন কাটল। বুঝলাম না কথাটা। এ দেখছি কাঁচের পেয়ালা, প্লাস্টিক আবার এলো কোত্থেকে।
হারুন চটে গেল? কি আশ্চর্য; কাঁচের পেয়ালা বলে প্লাস্টিক হতে জানে না; জানো, কাকে বলে প্লাস্টিক? সারাদিন তো বলে বেড়াবে আমার বেল্টটা প্লাস্টিকের, ঘড়ির ব্যাণ্ডটা প্লাস্টিকের, কলমটা প্লাস্টিকের, প্লাস্টিকের হেনটা তেনটা। এই সবুজ পেয়ালাটা যে প্লাস্টিকের ছিলনা কে বললে তোমাকে? না জেনে শুনে কেবল —
টুলু বলল, বেশ তো আজ না হয় তোমার কাছে প্লাস্টিকের কথাই শোনা যাক। বল শুনি প্লাস্টিক কাকে বলে! হারুন তখন টেবিলের কিনারার ওপর ঠেস দিয়ে বসে পকেট থেকে ফস করে কলমটা টেনে নিয়ে বেশ ভারিক্কি চালে রীতিমতো বক্তৃতা আরম্ভ করল :
এই যে দেখছ কলমটা, এটা এখন বেশ শক্ত, মেঝেতে ফেলে দিলেও ভাঙ্গবে না। এটা বরাবরই কিন্তু এ-রকম ছিল না। প্রথমে এটা ছিল নরম কাদার মতো, তখন তাকে ছাঁচে ফেলে এই কলম বানানো হয়েছে। এমনি ধাঁচের জিনিস, যেগুলো বেশ কাদা কাদামডেল করবার ‘পুটি’র মতো–তাদের নাম হল প্লাস্টিক। হাত দিয়ে বেশ চটকানো যায়–অর্থাৎ যাকে সাধু ভাষায় বলে নমনীয়-টিপেটুপে চাপ দিয়ে যেমন ইচ্ছে আকার দেওয়া যায়। টানো, কেমন লম্বা হয়ে যাচ্ছে; দলা পাকাও, গোল হয়ে যাবে। এই যেমন, কাঁচ।