কিন্তু এ-রকম বিদঘুঁটে আইনের ফল মোটেই ভাল হয় নি। নুনের মতো এমন একটা দরকারি জিনিস নিয়ে এমন ছেলেখেলা লোকে মানতে চাইবে কেন? এমনি নানা অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে ক্রমে ক্রমে দেশের লোক এমন ক্ষেপে ওঠে যে, আজ থেকে প্রায় দু’শো বছর আগে ১৭৮৯ সালে ফরাসি দেশে এক বিপ্লব হয়।
১৮৫৬ সালে ভারতবর্ষেও বিদেশী শাসকরা নুনের ওপরে চড়া ট্যাক্স বসিয়ে দেয়, সমুদ্রের ধারের লোকদের নুন তৈরি করা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফরাসি দেশের মতো এ-দেশেও লোকের মধ্যে দারুণ বিক্ষোভ দেখা দেয়। সে সময়কার সিপাহী বিদ্রোহ, তারপর গান্ধীজীর লবণ আইন অমান্য আন্দোলন এসবের কথা তোমরা নিশ্চয় শুনেছ।
তবে দেখ, জিনিসটা দেখতে সামান্য মনে হলেও আসলে এটা মোটেই হেলাফেলার জিনিস নয়–এই সামান্য নুন নিয়ে সারা দেশজোড়া কতো কি এলাহী ব্যাপার ঘটে যেতে পারে!
কিন্তু তোমরা হয়তো শুনলে তাজ্জব হবে এমন দরকারি যে নুন তা আমাদের পেটে নাকি হজম হয় না। কথাটা একেবারে মিছে নয়। একজন লোকের ওজন যদি হয় পঞ্চাশ কেজি তাহলে তার শরীরে মোটামুটি আধ কেজি নুন রয়েছে। জানো তো আমাদের শরীর হচ্ছে খুব ছোট ছোট অসংখ্য কোষ দিয়ে তৈরি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের শরীরের বেশির ভাগ কোষের মধ্যেই নাকি নুনের তেমন হদিস খুঁজে পাওয়া যায় না, বেশির ভাগ গাছের কোষেও না। নুন থাকে শুধু আমাদের রক্তের মধ্যে।
তোমরা হয়তো অমনি ফস করে জিজ্ঞেস করে বসবে? আর কোথাও না, কেবল রক্তের মধ্যে? তাহলে আমরা যে নুন খাই তা যায় কোথায়? আর তা দিয়ে শরীরের হয়ই বা কি?
সে এক মজার ব্যাপার। বলছি, শোন।
সমুদ্রের মধ্যেকার নিচুস্তরের যে-সব প্রাণী–যেমন, জেলি-ফিশ, অ্যানিমোনি, ঝিনুক, চিংড়ি–এদের গায়ে কোন রক্তই নেই। অর্থাৎ, রক্ত বলতে যা আছে তা আসলে সমুদ্রের পানিরই শামিল। এদের সারা গা দিয়ে সমুদ্রের পানি শরীরের ভেতর ঢুকে যায়। এই পানিই এদের সমস্ত হজম করা খাবার-দাবার শরীরের কোষে নিয়ে পৌঁছে দেয়।
সমুদ্রের উঁচুদরের মাছ আর ডাঙ্গার প্রাণীদের গায়ে যে রক্ত তা রীতিমতো নোনতা–এক ভাগ সমুদ্রের লোনা পানি আর তিন ভাগ সাধারণ মিঠে পানি মেশালে যেমন হবে অনেকটা তেমনি। ডাঙ্গার প্রাণীদের মধ্যে মানুষও পড়ে, কাজেই মানুষের রক্তও এমনি।
কিন্তু আমাদের রক্তের মধ্যে নুনের দরকারটা কি তাহলে? সে-কথা বুঝতে হলে একটু পৃথিবীর পুরনো ইতিহাসের কথা জানতে হবে।
আমরা সবাই আজকাল ডাঙ্গায় বসবাস করলে কি হবে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, আজ থেকে বহু কোটি বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা ওই জেলিফিশের মতোই সমুদ্রের তলায় থাকতো। সমুদ্রের তলায় থাকার তুলনায় প্রাণীদের ডাঙ্গার ওপর ওঠে থাকার সময়টা নেহাতই কম। বহু কোটি বছর ধরে সমুদ্রের তলায় থাকতে থাকতে জীবকোষগুলোর যে নোনা পানিতে ডুবে থাকার স্বভাব হয়ে গিয়েছে ডাঙ্গায় ওঠেও তা আর ছাড়ানো যায় নি। হয়তো তাই সমুদ্রের নিচুস্তরের জীবদের মতো আমাদের শরীরের কোষগুলোও অনেকটা নোনা পানিতেই ডুবে থাকতে চায়; আর সেই জন্যেই আমাদের রক্তের মধ্যে নুন না থাকলে এক দণ্ড চলে না।
কলেরা হয়ে কারো শরীর থেকে যদি খুব বেশি পানি আর নুন বেরিয়ে যায় তাহলে তাকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্যে ডাক্তাররা নুন-গোলা পানির স্যালাইন ইঞ্জেকশন দেন। আজকাল ডায়রিয়ার চিকিৎসার জন্যে ওরাল স্যালাইন বা লবণ-গুড়ের শরবত বেশ কাজ দিচ্ছে।
এই একই কারণে মানুষের মতো কুকুর, বেড়াল বা পাখিদেরও নুনের দরকার হয়। তবে এরা নুন ছাড়াও বেশ কিছুদিন কাজ চালিয়ে যেতে পারে; কিন্তু মানুষ, ঘোড়া বা গরু তা পারে না। তার কারণ মানুষ, ঘোড়া বা গরুর বেলায় আরো একটা ব্যাপার আছে। গরমের দিনে ঘেমে ঘেমে আমাদের শরীর ঠাণ্ডা রাখতে হয়। সারা শরীরের লোমকূপের গোড়া দিয়ে রোজ প্রচুর ঘাম বেরিয়ে আসে; এই ঘামের পানিটুকু বাষ্প হয়ে উবে গিয়ে শরীরকে ঠাণ্ডা করে। কিন্তু ঘামের সাথে শরীর থেকে প্রচুর নুনও বেরিয়ে যায়। অনবরত গা থেকে এমনি করে নুন বেরিয়ে যায় বলেই আমাদের রোজকার খাবারের সঙ্গে নিয়মিত নুন না খেলে চলে না।
সব জানোয়ার কিন্তু ঘামে না। যেমন, কুকুর বা বেড়ালের কেবল পায়ের তলায় আর মুখের খানিকটা জায়গা ছাড়া সারা গায়ে আর কোথাও ঘামের গ্রন্থি নেই। খুব বেশি গরমে ঠাণ্ডা হবার দরকার হলে কুকুর তাই জিব বার করে হাঁপায়। জিব থেকে যে বাষ্প বেরোয় তাতেই তার ঘামবার কাজ হয়, তাকে খানিকটা আরাম দেয়।
গরু বা ঘোড়ার শরীরে অনেক সময় নুনের টান পড়ে যায়। তাই গরমের দিনে তারা একে অন্যের গা চেটে চেটে নুন খায়। এদের শরীর ভাল রাখার জন্যে খাবারের সঙ্গে অল্প পরিমাণে নুন দিতে মানুষের মধ্যে যারা আবার খুব বেশি খাটুনির কাজ করে–যেমন খনির কাজ, জাহাজের বয়লারে কয়লা ঠেলার কাজ, কল-কারখানা বা মাঠের কাজ–তাদের সারা দিন অনবরত ঘামতে হয়। তাই তাদের শরীরে ঘাটতি মেটাবার জন্যে নুনের দরকার হয় খুব বেশি।
বিলেতে বা অন্যান্য ঠাণ্ডা দেশে লোক ঘামে কম, তাই সেখানে নুন খুব কম খেলেও চলে। কিন্তু আমাদের মতো গরম দেশের ব্যাপার ঠিক তার উলটো। তাই নুনের অভাব হলেও সারা দেশ জুড়ে হাহাকার পড়ে যায়-নুনের দাম দশ-বিশ টাকা কেজি বা তার বেশিও ওঠে।