মুখের লালার মধ্যেও সর্দির জীবাণু থাকে। হাঁচি দেবার সময় এই সব জীবাণু ছিটকে বেরিয়ে আসে। হাঁচির কণা বাতাসে অনেকক্ষণ ধরে ভাসতে থাকে। হয়তো কাপড়-চোপড়ে, ঘরের আসবাবপত্রে গিয়ে লাগে। তারপর আবার শুকিয়ে গিয়ে বাতাসে ওড়ে। রুমালে যে সর্দি শুকিয়ে লেগে থাকে, রুমাল ঝাড়লে তাও বাতাসে মিশে যায়। এই সব জীবাণু সুস্থ মানুষের নাকে গেলে তারও সর্দি লাগে।
সর্দি নিয়ে একটা মুশকিল হচ্ছে হাম ইত্যাদি রোগ যেমন একবার হয়ে গেলে একই লোকের সহজে আর হয় না–শরীরে আপনা আপনি একটা প্রতিরোধ শক্তি জন্মে যায়–সর্দির বেলায় সাধারণত তেমনটা হয় না। একবার সর্দি হয়ে সেরে যাবার দু’-এক সপ্তাহ পরেই হঠাৎ আবার সর্দি লেগে যেতে পারে। এর একটা কারণ হয়তো এই যে, হাম, ইনফ্লুয়েঞ্জা এসব রোগের জীবাণু রক্তে গিয়ে মেশে; আমাদের দেহে রোগ ঢোকাবার জন্যে যে সব অ্যান্টিবডি বা প্রতিবীজ জন্মায় সেগুলোও থাকে রক্তে। কিন্তু সর্দির বেলায় জীবাণু থাকে নাকের এবং শ্বাসনালীর শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর ওপরে। রক্তের প্রতিবীজ সেখানে তাদের কাবু করতে পারে না।
সর্দির ব্যাপারটা এমন গোলমেলে বলে, আর এ সম্বন্ধে তেমন ব্যাপক গবেষণা না হওয়ায় সর্দির চিকিৎসাও তেমন ভাল নেই। বাজারে অনেক ওষুধ পাওয়া যায় সর্দির জন্যে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় ধরা পড়েছে, বেশির ভাগ ওষুধ ব্যবহারে যে ক’দিনে সর্দি সারে, সে ওষুধ ব্যবহার না করেও মোটামুটি সেই ক’দিনেই সারে। সাধারণত অনেক সর্দি প্রথম অবস্থায় আপনা আপনি দমে যায়; তার ফলে অনেকের ধারণা হয় বুঝি ওষুধের বদৌলতেই সর্দি কাবু হয়েছে। কোন কোন ওষুধ দিয়ে সর্দির যন্ত্রণা কিছুটা কমানো যায়; কিন্তু এর সত্যিকার ওষুধ আজো বেরোয় নি।
নুনের মতন ভালবাসা
রূপকথাটা আদতে ছিল পাঞ্জাব দেশের; এখন ক্রমে ক্রমে আমাদের দেশেও চালু হয়ে গিয়েছে।
বাদশাহর একদিন কি খেয়াল চাপল, তাঁর শাহজাদীদের ডেকে শুধালেন : আচ্ছা, বল দেখি, তোমরা আমাকে কে কেমন ভালবাসো?
বড় রাজকন্যে জবাব দিলেন : ঠিক চিনির মতো।
মেঝো রাজকন্যে বললেন : মধুর মতো।
সেজো রাজকন্যের জবাব : খুব মিষ্টি আর খোশবুদার শরবতের মতো।
আর সবচেয়ে ছোট যে টুকটুকে কন্যাটি তিনি কি জবাব দিলেন, জানো? তিনি বললেন : বাবা, আমি তোমাকে ভালবাসি নুনের মতো।
শুনে তো বাদশাহ একেবারে থ খেয়ে গেলেন। বলে কি! শুধু নুনের মতো? ….
হ্যাঁ, নুনের মতো। রাজকন্যা তেমন বেয়াড়া কিছু বলেন নি। সত্যি সত্যি পানি আর হাওয়াকে বাদ দিলে আমাদের শরীরের জন্যে নুনের চেয়ে দরকারি জিনিস আর কি আছে? নুন এত দরকারি বলেই না কথায় বলে: “নুন খাই যার। গুণ গাই তার।”
আগের দিনে মিসর দেশে অবাধ্য গোলামদের সাজা দেওয়া হতো নির্জন কুঠরির মধ্যে ফেলে রেখে তাদের নুন খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে। শুনতে খুব সোজা মনে হলেও এ কিন্তু ভারি জবর সাজা। আলুনী খাবার খেয়ে খেয়ে ক’দিনের মধ্যেই লোকগুলো একেবারে নির্জীব মরার মতো হয়ে পড়তো। এই ভয়েই তাদের আর মালিকদের কোন রকম অন্যায় হুকুমও অমান্য করবার সাহস হতো না।
সেই রূপকথার রাজাও একদিন অবস্থাগতিকে পড়ে থরে থরে সাজানো বহু রকমের ভাল ভাল খাবার সামনে রেখেও নুন দেওয়া হয়নি বলে কোনটাই মুখে তুলতে পারলেন না; তখন ছোট মেয়ের কাছে শিক্ষা পেয়ে তিনি বুঝলেন আমাদের রোজকার জীবনে নুন সত্যি সত্যি কতখানি দরকারি জিনিস।
মানুষের ইতিহাস যেমন পুরনো, নুনের ইতিহাসও কিন্তু তেমনি পুরনো। হযরত ঈসা (আ)-এর জন্মেরও ২,৭০০ বছর আগে চীনদেশের একখানা বইতে প্রথম নুনের ব্যবহারের কথা পাওয়া যায়। সেই কোন্ পুরনো যুগ থেকে মিসর দেশে উটের পিঠে করে নুনের ব্যবসা চলতো, ইতিহাস থেকে তার কথাও আমরা জানতে পাই।
যতদূর জানা যায়, এশিয়া-মাইনর, আরব এসব দেশে আজ থেকে প্রায় দু’হাজার বছর আগে নুনের ব্যবসা চালু ছিল। আরবরা নুনকে একটা সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করতো। তাই বাণিজ্যের পসরা নিয়ে ধূ-ধূ মরুভূমির বুকে অনেক দূরের পথে কোন কাফেলা পাড়ি দেবার আগে যাতে ব্যবসায় খুব লাভ হয়, আর যাত্রীরা নিরাপদে ফিরে আসতে পারে, সে জন্যে তারা খানিকটা নুন পুড়িয়ে নিতো।
সে-সময়ে এসব মুন সবই তৈরি হত সমুদ্রের লোনা পানি রোদে রেখে বা জ্বাল দিয়ে শুকিয়ে ফেলে। সমুদ্রের পানি হল পৃথিবীতে নুনের এক বিশাল ভাণ্ডার। সমুদ্রের নুন দেখতে একটুখানি কালচে রকমের আর মোটা দানার। আমাদের দেশে বাজারে যে নুন বিক্রী হয় তার বেশির ভাগই সমুদ্রের পানি থেকে তৈরি। চট্টগ্রামে সমুদ্রের কাছাকাছি এলাকায় লোনা পানি শুকিয়ে প্রচুর নুন তৈরি হয়। মাটির নিচে যে আবার বিরাট বিরাট জমাট নুনের কাড়ি পাওয়া যায় এটা আবিষ্কার হয়েছে আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে পোলাও দেশে। পোলাত্রে এই নুনের খনি এত বিরাট যে, হাজার বছর ধরে এখান থেকে অনবরত নুন তোলা হচ্ছে, কিন্তু আজও তার শেষ হবার কোন লক্ষণ নেই।
আজকাল যেমন ইচ্ছে হলেই বাজার থেকে যত খুশি নুন কিনতে পাওয়া যায়, আগেকার দিনে কিন্তু মোটেই এমনি ছিল না। তখন নুন ছিল একটা বেজায় রকমের দামী জিনিস, আর তার মর্যাদাও ছিল তেমনি। ১৯২৯ সালে ফরাসি দেশে একটা আইন করে বলে দেওয়া হয় যে সাধারণ লোকেরা আর নিজেদের খুশিমতো নুন তৈরি করতে পারবে না। দেশের খরচ চালাবার জন্যে নুনের ওপর এমনভাবে ট্যাক্স বসাবার ব্যবস্থা করা হয় যাতে গরিব লোকেরা নুন কিনতে না পারে, কেবল যাদের অনেক টাকা-কড়ি আছে তারাই কিনতে পারে।