কিন্তু জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে মানুষের সব কিছু জানবার ইচ্ছেও বেড়েছে। তার ফলেই আজ আমরা প্রকৃতির এমন নানা রহস্যের খোঁজ পেয়েছি যাতে মানুষের জীবন আগের চাইতে অনেক বেশি সহজ আর সুন্দর হয়ে উঠেছে।
মানুষের এই অজানাকে জানার প্রবল আগ্রহের দরুনই আজ আমরা জানি যে, পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র ঠিক আজকে যেমনটি রয়েছে চিরদিন এরকম থাকতে পারে না—পরিবর্তন হবেই। আজ যেখানে বিরাট পাহার দাঁড়িয়ে আছে, একদিন হয়তো সেখানে হবে বিশাল সমুদ্র; আজ যেখানে আছে গভীর সমুদ্র সেখানে হয়তো বা সৃষ্টি হবে হিমালয়ের মতন বিশাল পর্বত।
আর তোমরা শুনে অবাক হবে, দুনিয়ার সব চাইতে বড় পর্বত যে হিমালয়, সেটা একদিন সত্যি সত্যি সমুদ্রের নিচে ডুবে ছিল। ভূ-বিজ্ঞানীদের (অর্থাৎ যেসব বিজ্ঞানী দুনিয়ার গড়ন নিয়ে নাড়াচাড়া করেন) মতে, দুনিয়াতে বড় বড় যত পাহাড় আছে তার মধ্যে হিমালয়ের বয়সই নাকি সব চাইতে কম; এত কম যে ‘বুড়ো খোকা’ হিমালয়ের নাকি এখনও গড়ে ওঠাই শেষ হয় নি। একটু যুতসই মতো নড়েচড়ে বসতে গিয়েই আসামের ভূমিকম্পটা হয়ে গেল।
হিমালয়ের জন্ম সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা বলেন, একবার একটা বিরাট ভূমিকম্প হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের তলাটা মিন্দানাও দ্বীপের কাছে অনেকখানি বসে যায়, আর সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর উলটো দিকে গজিয়ে ওঠে বিরাট হিমালয় পর্বত। এটাও সেই ভূমিকম্পেরই কীর্তি।
তোমরা হয়তো বলবে, হিমালয় যে একদিন সত্যিই সমুদ্রের নিচে ছিল, তা কী করে বোঝা গেল?-হ্যাঁ, তারও প্রমাণ আছে বৈকি। বিজ্ঞানীরা হিমালয় পাহাড়ের চূড়োয় বরফের ভেতর থেকে এমন সব ফসিল হয়ে যাওয়া শামুক, ঝিনুক আর মাছের হাড় খুঁজে বের করেছেন যেগুলো বহু লক্ষ বছর আগে গভীর সমুদ্রের তলাতেই কেবল পাওয়া যেত। এ থেকেই বোঝা যায় পৃথিবীর ওপর একটা ওলট-পালট হয়ে সমুদ্রের নিচে থেকে পাহাড়টা ওপরের দিকে মাথা তুলে দিয়েছিল, আর তখনই ওই সব শামুক আর মাছের কাঁটাগুলোও ওপরে ওঠে যায়।
তোমরা শুনে আরো আশ্চর্য হবে, আজ যেখানটায় চাটগাঁ শহর সে জায়গাও যে এককালে সমুদ্রের তলায় ডুবে ছিল বিজ্ঞানীরা চাটগাঁয় পাহাড়ের মাটির স্তর পরীক্ষা করে নাকি তারও প্রমাণ পেয়েছেন।
ঐতিহাসিক যুগেই একবার মানুষের চোখের সামনে একটা অদ্ভুত কাণ্ড হয়। ১৭৫৫ সালে এক ভূমিকম্পে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন শহরের একটা অংশ ষাট হাজার লোক নিয়ে মাত্র ছ’মিনিটের মধ্যে একদম সমুদ্রের ভেতর তলিয়ে যায়।
করাচির কিছুটা নিচে ভারতের ম্যাপে দেখবে একটা ঠোঁটের মতন জায়গা বেরিয়ে আছে-এটাকে বলে কাথিওয়াড় উপদ্বীপ। এর উত্তরে যে কচ্ছ উপসাগর, এটা মাত্র দুশো বছর আগেও ছিল একটা শুকনো জায়গা। জায়গাটা ১৮১৯ সালে সমুদ্রের ভেতর ডুবে গিয়েছে।
আজকাল বিজ্ঞানীদের মত হচ্ছে, সব সময়েই দুনিয়ার ওপরে কোন না কোন জায়গায় ছোটখাট ভূমিকম্প হচ্ছেই। প্রতি বছর দুনিয়াতে ছোটবড় কয়েক লক্ষ ভূমিকম্প হতে পারে। তবে ১৯৫০ সালে আসামের ভূমিকম্প বা ১৯৬৮ সালে ইরানের খোরাসান এলাকায় যে ভূমিকম্পে এক সঙ্গে প্ৰয় ২৫,০০০ লোকের প্রাণ হারায়। এত বড় ভূমিকম্প খুব কমই হয়ে থাকে।
ভূমিকম্পের নানান কারণ থাকতে পারে; যেমন জোয়ার-ভাটার টান, জলপ্রপাত, আগ্নেয়গিরি এই সব। তাছাড়া, পৃথিবীটা সব সময় তার মেরুদণ্ড ত্যারচা রেখে সূর্যের চারদিকে ঘোরে, তার জন্যেও নাকি এর ভেতরে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয়।
তবে মোটামুটিভাবে বিজ্ঞানীদের মতে ভূমিকম্পের আসল কারণ হচ্ছে মাটির নিচে কোন স্তর ফেটে যাওয়া—-যাতে করে আশেপাশের স্তরগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে সেখানে পড়তে থাকে। তাহলেই তোমরা এবার প্রশ্ন করে বসবে, কিন্তু এই স্তরগুলো ফাটে কেন?
প্রশ্নটা মোটেই সহজ নয়–তবু একবার বোঝার চেষ্টা করা যাক।
পৃথিবীর ওপরটা দিব্যি ঠাণ্ডা দেখলে কি হয়, ভেতরে এর এখনও দস্তুরমতো গরম। যারা মাটির নিচে খনির ভেতরে নেমে কাজ করে তারাই এটা জানে। ভেতরটা এত গরম যে, মাটির শ’খানেক কিলোমিটার নিচেই ধাতুগুলো প্রায় গলা অবস্থায় রয়েছে পৃথিবীর ওপরকার অংশটা তারই ওপরে ভাসছে।
পৃথিবীর ভেতরকার এই তাপ সব সময়েই নানানভাবে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছে–আর তার ফলে পৃথিবীটা ক্রমে ক্রমে ঠাণ্ডা হচ্ছে আর সংকুচিত হয়ে আসছে। তাছাড়া পৃথিবীর ওপরকার লক্ষ লক্ষ টন ওজনের পাহাড় পর্বত আর মাটির স্তরের চাপ পড়ছে ভেতরের ওই প্রায় তরল অংশের ওপরে। এর দরুনও ভেতরকার স্তরের খানিকটা সংকোচন হয়। অবশ্যি এই সংকোচন খুবই সামান্য–একশো বছরে হয়তো কয়েক সেন্টিমিটার মাত্র।
কিন্তু এসবের জন্যে পৃথিবীর বাইরের দিককার স্তরগুলোর ওপর একটা দারুণ রকমের চাপ পড়ছে–অনেক সময় চাপের চোটে এগুলো বাঁকা হয়ে ভাঁজ হয়ে যায়।
ধর, একটা রবারের বলের ওপর তুমি আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিচ্ছ, এতে বলটা খানিকটা টোল খেয়ে সংকুচিত হয়ে যাবে। তারপর হাতটা ছেড়ে দাও, সঙ্গে সঙ্গে নিচু জায়গাটা আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। এই যে আগের অবস্থায় ফিরে আসার চেষ্টা, এর নাম হচ্ছে স্থিতিস্থাপকতা গুণ।
পৃথিবীরও এই রকম স্থিতিস্থাপকতা আছে। তাই চাপ পড়ে কুঁচকে যাওয়া স্তরগুলো সব সময়েই আবার তার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চাইছে। চাপ বাড়তে বাড়তে যদি এমন অবস্থায় পৌঁছয় যে স্তরগুলো আর কিছুতেই তা সইতে পারছে না, তাহলে স্তরটা হঠাৎ ফেটে যায়। কিংবা হঠাৎ যদি কোন প্রাকৃতিক কারণে চাপ বেশি রকম কমে যায় তাহলেও স্তর ফাটতে পারে।–আর অমনি শুরু হয় একটা বিরাট আলোড়ন।