মামা যখন ঘড়ির কাহিনী শেষ করলেন তখন বেশ রাত হয়েছে, নীলুর চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। মামার বলার পরও নীলু শুনতে পেল টেবিল ঘড়িটা যেন বলে চলেছে? টিক্ টিক্…..টিক্ টিক্….টিক্ টিক্…..
——–
*গ্রীনিচ জায়গাটা লণ্ডনের কাছে। গ্রীনিচের ঘড়িতে যখন ভোর ছটা বাংলাদেশে তখন দুপুর বারোটা। বিলেতের ঘড়িগুলো ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পশ্চিম ইউরোপের সাধারণ সময় ধরে চলে –G.m.T-র এক ঘণ্টা আগে আগে।
টলমল পদভরে
১৯৫০ সনের ১৫ই আগস্ট। রাত তখন গোটা নয়েক হবে। হঠাৎ ঘড়-বাড়ি দালান-কোঠা সব দুলে উঠল। মাথার ভেতরটা আচমকা বোঁ করে ঘুরে উঠতেই সবাই বুঝতে পারল ব্যাপারটা কী। ভূমিকম্প, ভূমিকম্প’ : একটা মাতাল দৈত; যেন তার পায়ের দাপটে পৃথিবী কাঁপিয়ে এগিয়ে আসছে–ক্রমাগত এগিয়ে আসছে….।
তারপর জানা গেল, দৈত্যটা সারা দেশের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড তাণ্ডব নৃত্য করতে করতে পাহাড়-নদী, শহর-গ্রাম, বাড়ি-ঘর সব দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে গিয়েছে। কেবল আসামেই নয়–ঢাকায়, কোলকাতায়, এমন কি আসাম থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে পর্যন্ত এই ভূমিকম্পের ধাক্কা গিয়ে লেগেছে। রোজকার রোজ খবরের কাগজে বড় বড় হরফে ছাপা হতে লাগল আসামের ভূমিকম্পের খবর।
পঞ্চাশ বছরের মধ্যে দুনিয়াতে এত বড় ভূমিকম্প কখনোও হয় নি। আসামের উত্তর-পুব সীমান্তের কোণায় তিব্বতের পাহাড়ের ভেতর থেকে এই ভূমিকম্পের শুরু। তার জোরালো কাঁপুনির ধাক্কায় প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার দূরে পুণার মান-মন্দিরে ভূমিকম্পের কাঁপুনি-ধরা যন্ত্রের কাঁটা যায় একদম বিগড়ে। কোলকাতা শহরেও কাঁপুনি-মাপা কাটা যন্ত্র থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায়। তাহলেই এখন বোঝ কী ভীষণ ব্যাপারখানা!
ভূমিকম্পে আসামের তিন ভাগের দুভাগ এলাকাতেই সব চাইতে বেশি ক্ষতি হয়। হাজার হাজার ঘড়-বাড়ি ভেঙ্গে পড়ে। তার ওপর সবচেয়ে বড় কথা হল, ভূমিকম্পের ফলে পাহাড়ের বিরাট বিরাট ধ্বস নেমে ব্রহ্মপুত্র এবং অন্যান্য নদীর পথ বন্ধ হয়ে যায়। এতে ব্রহ্মপুত্র, ডিব্ৰু, দিহাং, সুবনসিরি–এই সবগুলো নদীতে বিপুলভাবে বান ডাকে। আর এই বানে সারা দেশ ভেসে গিয়ে হাজার হাজার গরু, মোষ, জন্তু-জানোয়ার, মানুষ মারা পড়ে।
ভূমিকম্পের পরে যারা উড়োজাহাজে করে ওসব এলাকা সফর করে এলেন তারা বললেন, সমস্ত পাহাড়ী দেশের চেহারা রাতারাতি একদম বদলে গিয়েছে। হিমালয় পর্বতের বিরাট একটা অংশকে নাকি আর খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না অনেক পাহাড়ের চূড়া বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে। নদীর পথ-ঘাট গিয়েছে বদলে। আবর আর মিমি পাহাড়ের কাছে কয়েক হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা সমস্ত সভ্য জগৎ থেকে একেবারে আলাদা হয়ে পড়েছে।
বড় একটা কাণ্ড ঘটলে যেমন হয়, আসামের ভূমিকম্পের পর নানান জনে এর সম্বন্ধে নানান কথা বলতে শুরু করলেন। কেউ বললেন, গৌরীশৃঙ্গের চূড়োটা এইবার আরও খানিকটা উঁচু হয়ে গিয়েছে। কেউ বলেন, না না, আসল কথা হচ্ছে। সমস্ত হিমালয় পাহাড়টাই আস্তে আস্তে দক্ষিণ দিকে নেমে আসছে। আবার কেউ বলেন, ওসব কিছুই নয়–দুনিয়া পাপে-তাপে এমন ভরে উঠেছে যে পৃথিবীর আর মোর্টেই সহ্য হচ্ছে না, এটা তারই একটা লক্ষণ মাত্র!
কিন্তু যত জনে যত কথাই বলুক, ১৫ই আগস্টের পর থেকে কিছুদিনের মধ্যে আসামের নানা জায়গায় ছোটখাট সব মিলিয়ে কয়েক শো ভূমিকম্প হল। বিজ্ঞানীরা বললেন, ওতে ঘাবড়াবার কিছু নেই; বড় রকম একটা ভূমিকম্পের পর ওসব ছোটখাট ধাক্কার রেশ মিটতে এক বছরও লাগতে পারে।
ভূমিকম্প সম্বন্ধে মানুষের ভয় চিরকালের। আর ভয় থাকবে না-ই বা কেন? এ তো আর বাঘ-ভালুক সাপ নয় যে, দল বেঁধে শিকার করে কাবু করা যাবে। ধরিত্রী যখন হঠাৎ একবার উত্তাল হয়ে ওঠে তখন মাঝে মাঝে একেবারে প্রলয়কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে। কাজেই আগের দিনের মানুষ ভূমিকম্পকে দৈব ব্যাপার মনে করে ভয় করবে, এ তো খুবই স্বাভাবিক।
আগেকার দিনে একদল লোক ভূমিকম্পের কারণ সম্বন্ধে বলত সহস্র ফণাওয়ালা নাগরাজ বাসুকি পৃথিবীকে তার মাথার ওপর নিয়ে আছেন; মাঝে মাঝে হয়রান হয়ে তিনি পৃথিবীকে এক ফণা থেকে আরেক ফণার ওপর নিয়ে যান আর তখনই ভূমিকম্প হয়।
গ্রীকদের পুরাণেও ভূমিকম্পের কারণ সম্বন্ধে এমন ধরনের এক কাহিনী আছে। তবে তারা বলত, নাগরাজ বাসুকি-টাসুকি নয়, পৃথিবীটা রয়েছে আসলে দেবতা হারকিউলিসের কাঁধের ওপরে। তিনি তাকে এক কাঁধ থেকে আরেক কাঁধে বদলি করেন; তাই ভূমিকম্প দেখা দেয়।
আজকের বৈজ্ঞানিক যুগে অবশ্য এ ধরনের কাহিনী আর কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। কেননা, আজকের একেবারে বাচ্চা ছেলেটিও জানে যে, হারকিউলিসের কাঁধও নয় বাসুকির ফণাও নয়, পৃথিবীটা নেহাতই শূন্যের ওপর ঝুলে আছে।
প্রকৃতির নিয়মের রাজত্বে কোন রকম ব্যতিক্রম ঘটলেই প্রলয় হয়–ভূমিকম্পও এমনি একটা প্রলয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা ভাবতেন, পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র এগুলো আজকে যেমনটি আছে তেমনি চিরকাল থাকবে; এর কোন রকম ব্যতিক্রমের কথা চিন্তা করাও ছিল তাদের কাছে পাপ। তাই কোন জায়গায় হঠাৎ কিছু একটা পরিবর্তন ঘটে গেলেই তারা দারুণ হকচকিয়ে যেতেন।