বিলেতে এই সব আবিষ্কার হবার পর সারা দেশ জুড়ে বিরাট বিরাট সব কল-কারখানা গড়ে ওঠতে লাগল। গাঁয়ের চাষীরা দল বেঁধে কাজের খোঁজে ছুটল শহরের দিকে; রাতারাতি আশে-পাশের সব কিছু যেন বদলে যেতে লাগল। আঠারো শতক ইতিহাসের দিক থেকে খুব দূরের কথা নয়। কিন্তু গেল এই দুশো বছরে বিজ্ঞান আর কল-কবজার সাহায্যে মানুষের জীবনে যা পরিবর্তন ঘটেছে তার আগের দুহাজার বছরেও তা হয় নি। এ-সবই হয়েছে যন্ত্রের আবিষ্কার থেকে; আর আসলে তার গোড়ায় রয়েছেন ঘড়ির কারিগররা।
সে সময়ের ঘড়ির কারিগররা শুধু যে দরকারি যন্ত্রপাতিই বানিয়েছিলেন তা নয়। তখনকার হাওয়া ছিল যন্ত্রের নেশায় ভরপুর! কারিগরদের নানা রকম যন্ত্র বানাবার এমন ঝোঁক চেপেছিল যে অদ্ভুত বুদ্ধি খাঁটিয়ে তারা বহু ধরনের আজব জিনিস বানাতে শুরু করে দেন। তার একটা হল ‘কলের মানুষ। কয়েক জন কারিগর এমন কলের খেলনা বানিয়ে ফেলেন যা মানুষের মতো গান গায়, বাঁশি বাজায়, লেখে, কাজ করে।
তারপর তৈরি হল কলের ক্যালেনডার। এই ক্যালেনডারে বছর শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সপ্তাহের দিনগুলো আপনা আপনি পালটে যায়, ক্যালেন্ডার বদলাবার আর দরকার হয় না। জার্মানির স্ট্রাসবুর্গ শহরের বড় গীর্জাতে ঘড়ির সাথে এই রকম ক্যালেনডার রয়েছে সারা বছরের কোন তারিখ কি বার সেটা এর ডায়ালের দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায়। প্রত্যেক বছর এই ক্যালেনডারের দিন-তারিখ আপনা থেকেই বদলায়।
বিলেতের পার্লামেন্ট ভবনের চূড়ায় বসানো ‘বিগ বেন’ ঘড়ির কথা একবার বলেছি। ‘বিগ বেন’ ঘড়ির রাজ্যে এক আশ্চর্য। কত বড় এই ঘড়ি, শুনবে? এর মোট ওজন ৫ টন, অর্থাৎ প্রায় ১৪০ মণ। চূড়োর চার দিকে এর চারটে মুখ, প্রত্যেকটা মুখ চওড়ায় ২৩ ফুট করে। মিনিটের কাঁটাটা লম্বায় ১৪ ফুট (চার মিটারের বেশি); সারা বছরে তাকে একশো মাইল পথ চলতে হয়। দুটো মিনিটের দাগের মধ্যে তফাত হচ্ছে এক বর্গফুট, আর ঘণ্টার সংখ্যাগুলো উঁচুতে দু’ফুট করে।
এই দানব ঘড়ি ‘বিগ বেন’-ই শুধু নয়, আমাদের ছোট ছোট হাত-ঘড়িগুলোও কিছু কম আশ্চর্য নয়। ওই ছোট খোলসটার মধ্যে অত সূক্ষ্মযন্ত্রপাতি কি করে পোরা হয়েছে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। দেয়াল-ঘড়ির সময় ঠিক রাখা হয় দোলক বা পেণ্ডুলাম দিয়ে। কিন্তু হাতঘড়ি তো আর এমনি করে সব সময় এক অবস্থায় ঝুলিয়ে রাখা যায় না, ওতে তাই দোলক ব্যবহার করার উপায় নেই। তাহলে হাতঘড়ির সময় ঠিক রাখা হয় কি করে?–ফুলের মতো সরু তারের স্প্রিং দিয়ে। এই স্প্রিং ব্যালান্স হুইল নামে একটা চাকাকে দোলায়; দেয়াল-ঘড়িতে পেণ্ডুলামের দোলানি যেমন বরাবর ঠিক সময় দেয়, স্প্রিং-এর কাঁপুনির হারও তেমনি সব সময় একই থাকে। যে হয়গেনস দেয়াল-ঘড়ির জন্যে প্রথম পেলাম ব্যবহার করেছিলেন, তিনিই পকেট ঘড়ি চালাবার জন্যে প্রথম স্প্রিং দিয়ে দোলানো ব্যালান্স হুইল ব্যবহার করেন।
যন্ত্রপাতি যত ভালই হোক, মাঝে মাঝে বিগড়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। ঘড়িও যে মাঝে মাঝে খারাপ হবে তাতে আর আশ্চর্য কি? ঘড়ি ভালভাবে চলবার জন্যে ওর ভেতরকার যন্ত্রপাতি বিশেষভাবে তৈরি জলপাই-এর তেল বা আরো ভাল কোন তেলে ভিজিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু বাতাস লাগতে লাগতে এই তেল ঘন হয়ে খারাপ হয়ে যায়। সূক্ষ্ম যন্ত্রগুলো গায়ে গায়ে ঘষা লেগে আর ভাল চলতে পারে না।
ধুলো-ময়লা, পানি বা ঝাঁকুনিতেও ঘড়ির খুব ক্ষতি করে। কিংবা ঘড়ির কোন স্প্রিং যদি ছিঁড়ে যায় তাহলেও তার টিক টিক শব্দ যায় থেমে। তখন তাকে ঘড়ির কারিগরের কাছে দেওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। তবে সাবধানে ব্যবহার করলে ঘড়ি ঘন ঘন মেরামতের দরকার হয় না।
সব চাইতে নিখুঁতভাবে সময়ের হিসাব দরকার জাহাজ চালাবার জন্যে। গোড়াতেই বলেছি, দুনিয়ার এক এক জায়গায় সূর্যের সময় এক এক রকম। অথই সমুদ্রে জাহাজ ঠিক কোন জায়গায় আছে সেটা নিখুঁত ঘড়ি আর সূর্য বা তারা দেখে বুঝতে পারা যায়। কিন্তু মুশকিল হল, জাহাজে সাধারণ ঘড়িকে কিছুতেই ঠিক রাখা যায় না সমুদ্রের অনবরত ঝাঁকুনিতে ঘড়ি ফাস্ট কি স্লো হয়ে যায়। আর ঘড়ি সামান্য বেঠিক হলেও দিক ভুল হবার ভয় পদে পদে।
সেই জন্যে জাহাজের উপযোগী একটা নিখুঁত ঘড়ি তৈরি করে দেবার জন্যে ১৭১৪ সালে বিলেতের পার্লামেন্ট দশ হাজার পাউণ্ড পুরস্কার ঘোষণা করেন। সারা দুনিয়ার ঘড়ির কারিগরদের বহু বছরের চেষ্টার পর জন হ্যারিসন নামে এক ইংরেজ কারিগর আর ফরাসি কারিগর লে’রয় ক্রনোমিটার নামে বিশেষ ধরনের নিখুঁত ঘড়ি তৈরি করেন। কিন্তু এসব ক্রনোমিটার’ ঠিক সময় দিলে কি হবে, তার কল-কবজা আবার এত সূক্ষ্ম যে আবহাওয়া সামান্য বদলালে, ঠাণ্ডা কিংবা গরমে এর সময়ের এদিক-ওদিক হয়ে যেতে পারে। তাই জাহাজে ক্রনোমিটারকে রাখতে হয় বায়ুশূন্য কাঁচের পাত্রের মধ্যে।
আজকাল অবশ্য বেতার যোগাযোগের ব্যবস্থা হওয়ায় সারা নিয়া জুড়ে–এমন কি, জাহাজেও–ঠিক সময় রাখা অনেক সহজ হয়ে এসেছে। গ্রীনিচের এবং অন্যান্য জায়গার বড় বড় মান-মন্দিরে আকাশের তারার চলাচলের সাথে সব চাইতে নিখুঁত ঘড়ির সময় মিলিয়ে রাখা হয়। তারপর রোজই সেই সময় রেডিও মারফত ঘোষণা করা হয়; আর নিমেষের মধ্যে দুনিয়ার সব লোক তা জানতে পারে–রেডিওর সাথে মিলিয়ে নিজেদের ঘড়ি ঠিক করে নেয়।