প্রথম প্রথম যখন এমনি স্প্রিং-ওয়ালা ছোট ঘড়ি বের হল তখন ঘড়ির বাজারে রকম-বেরকম ফ্যাশনের স্রোত বই তে লাগল। প্রথম দিককার কতকগুলো ঘড়ি তৈরি হয়েছিল ডিমের মতো আকারের, তাদের নাম দেওয়া হল নুরেমবুর্গের ডিম’। তারপর ক্রমে ক্রমে বেরুতে লাগল প্রজাপতি বা ফুলের মতো ঘড়ি; নানা রকম লতা-পাতা-আঁকা, দামী দামী পাথর বসানো রকম-বেরকমের ঘড়ি।
এত সুন্দর আর বাহারে জিনিস পকেটে পুরে রেখে কি আর মনের শখ মেটে; শৌখিন লোকেরা তাই এ-সব ঘড়ি লোককে দেখাবার জন্যে মেডেলের মতো গলায়
আটকে গেলো দম বা বুকের ওপর ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। ক্রমে ক্রমে ঘড়ির কারিগররা ছোট ঘড়ি বানাতে এমন ওস্তাদ হয়ে ওঠে যে তারা কানের দুলে বা হাতের আংটিতে বসানো যায় এরকম ঘড়ি বানাতে শুরু করে। এসব সূক্ষ্ম কাজে তাদের নিপুণতা দেখে আজও আমাদের অবাক হতে হয়।
আজকাল যেমন ঘড়ির সব অংশ কারখানায় ছাঁচে তৈরি হয়, তারপর কারিগররা সেগুলোকে শুধু একসাথে জুড়ে দেয়, আগেকার দিনে মোটেই সে-রকম ছিল না। তখন প্রত্যেকটা অংশই হাত দিয়ে বানাতে হত। কাজেই ঘড়ি আজ যেমন সস্তা হয়েছে, তখন মোটেই সে-রকম ছিল না। আর তাই সেকালে বড় বড় নবাব-জমিদার রাজ-রাজড়া ছাড়া আর কারো ঘড়ি কিনার সাধ্য হত না। অবশ্য রাজ-রাজড়ারা খুশি হয়ে কাউকে কাউকে ঘড়ি উপহার দিতেন।
ঘড়ির কাহিনী বলতে গিয়ে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে আবার একটু ফিরে যাওয়া যাক। বলেছিলাম নানা রকম ভাবে সময় মাপা যায়; যাতে নির্দিষ্ট হারে সময় লাগে–যেমন বই পড়তে পাতা গুনে, কিংবা বাতির তেল কতটা ফুরলো তাই দেখে আগে সময় মাপার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু তাবলে নিখুঁতভাবে সময় মাপবার জন্যে যেমন-তেমন সব রকম হিসাবের ওপর তো আর নির্ভর করা চলে না। যেমন ধর, কামারশালায় হাতুড়ি পেটাতে মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট হারে সময় লাগে; তাই বলে সময় মাপার জন্যে কেউ কি আর একটা হাতুড়ি পিটে যেতে পারবে? আর তাছাড়া হাতুড়ি পেটার সময় যে ঠিক একেই হারে হবে, তারও তো কোন নিশ্চয়তা নেই।
এইসব অসুবিধের কথা ঘড়ি তৈরি করতে গিয়ে মানুষ বহুদিন ধরেই ভাবছে। যুগ যুগ ধরে মানুষ দেখেছে একদিন সকালে সূর্য ওঠা থেকে পরদিন সূর্য ওঠা পর্যন্ত সময়টা মোটামুটি স্থির। কাজেই সেই সময়কে সমান ২৪ ভাগ করে সূর্য-ঘড়ি তৈরি হল। কিন্তু তারও অনেক অসুবিধে।
জল-ঘড়িতে পাত্র থেকে সমান পরিমাণ পানি বেরিয়ে যেতে বার বার একই সময় লাগে; কিন্তু একটু ময়লা-টয়লা লেগে তলার ফুটোটা আটকে গেলেই সমস্ত গোলমাল হয়ে গেল। তাছাড়া সবচেয়ে ভাল যে জল-ঘড়ি তাতে ও কেবল ঘণ্টার হিসাবই মাপা যেত, মিনিটের কোন কথা ছিল না। তারপর তৈরি হল কিছুটা উন্নত ধরনের ওলনদার ঘড়ি। কিন্তু এ ঘড়িও নিখুঁতভাবে সময় দিতে পারত না; তাকে সব সময় আকাশের সূর্যের সাথে মিলিয়ে ঠিক করে রাখতে হত। আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে একটি ছেলে ঠিক এই কথা নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছিল? কোন জিনিস নির্দিষ্ট হারে সময় দেয়। তার নাম হল গালিলিও গালিলাই (Galileo Galilei)। গালিলিও আজ সারা দুনিয়ায় একজন সেরা বিজ্ঞানী বলে পরিচিত। কিন্তু সূর্যের চারধারে পৃথিবী ঘুরছে, এই সত্যি কথাটা বলার অপরাধে সেদিন সেই অন্ধযুগের লোকেরা তাকে প্রায় পুড়িয়ে মারবার যোগাড় করেছিল।
ছোট বেলায় গালিলিও একদিন গীর্জায় গিয়েছেন; মাথার ওপর একটা ঝাড়বাতিকে অনবরত দুলতে দেখে তাঁর মাথায় হঠাৎ বিদৎ খেলে গেল। তাঁর মনে হল প্রত্যেক দোলায় ঝাড়বাতিটার যেন একই রকম সময় লাগছে। তারপর তিনি অনেক পরীক্ষা করে দেখলেন, একটা সুতোর আগায় পাথর বা এমনি ভারি কিছু বেঁধে দোলালে তার প্রত্যেকটা দোলায় সব সময় ঠিক একই সময় নেয়। এই সময় অবশ্য নির্ভর করে সুতো কতখানি লম্বা তার ওপরে সুতো কমালে-বাড়ালে সময়ও সেইভাবে কমে-বাড়ে। সুতো বা সরু দণ্ডের আগাই ভারি কিছু বাঁধা এই ব্যবস্থাটার নাম হল পেণ্ডুলাম বা দোলক। এমনি করে গালিলিও এত দিনকার একটা মস্ত বড় সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। কিন্তু তিনি একে ঘড়ি তৈরির কাজে ব্যবহার করতে পারেন নি; পেণ্ডুলাম দিয়ে ঘড়ি বানালেন আর একজন বিজ্ঞানী, নাম তার ক্রিস্টোফার হয়গেনস। তার ফলে ঘড়ি দিয়ে সময় মাপা আগের চাইতে অনেকখানি নিখুঁত হয়ে এলো। আগেকার ঘড়িতে ছিল শুধু ঘণ্টার কাঁটা; এবার তার সাথে যোগ কর হল মিনিটের কাঁটা, তারপর সেকেন্দ্রে কাঁটা।
ঘড়ির উন্নতি কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে যায় নি। দিন দিনই ঘড়ির আরো উন্নতি হচ্ছে, ঘড়ির দামও তেমনি কমছে, আর সাধারণ লোকদের কাছেও ঘড়ি পৌঁছচ্ছে। সব আবিষ্কারের বেলাতেই এমনি হয়। প্রথম প্রথম জিনিসটা থাকে নতুন; অল্প গুটিকয়েক লোক তার কথা জানে, আরো অল্প লোক তাকে ব্যবহার করতে পারে। তার পরেও বিজ্ঞানীদের গবেষণা চলতে থাকে, আরো তার উন্নতি হয়, সমাজের সব রকম লোকের মধ্যে তার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে।
সেকালে আজকের মতো বিজ্ঞানের এত উন্নতি হয় নি, এত নানা রকমের কল-কবজার আবিষ্কারও হয় নি। বলতে গেলে, ঘড়ির কারিগররাই এই সব কল-কবজার আবিষ্কারের পথ দেখিয়ে ছিলেন। সেকালে যারা বড় বড় আবিষ্কার করেছেন তারা সবাই ছিলেন ঘড়ির কারিগর; যেমন বিলেতের আর্করাইট, হারগ্রী ফুলটন–এঁদের নাম হয়তো তোমরা শুনেছ। সুতো বোনার কল, কাপড়ের কল আর কলের জাহাজ আবিষ্কার করে এরা মানুষের জীবনযাত্রায় যুগান্তর এনেছেন। এই সব কল-কবজা বানাবার জন্যে তারা ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যে শেখেন নি। ঘড়ির কারখানায় হাতে-কলমে কাজ করতে করতেই তাদের সে শিক্ষা হয়েছে।