এই জাবলী দেশ দক্ষিণে ও দক্ষিণ-পশ্চিমে শিবাজীর রাজ্য-বিস্তারের পথ বন্ধ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। তিনি রঘুনাথ বল্লাল কোরডেকে বলিলেন, “চন্দ্রারাওকে না মারিলে রাজ্যলাভ হইবে না। তুমি ভিন্ন একাজ আর কেহ করিতে পারিবে না। আমি তোমাকে দূতরূপে তাঁহার নিকট পাঠাইতেছি।” রঘুনাথ সম্মত হইলেন এবং শিবাজীর পক্ষ হইতে সন্ধি-প্রস্তাব বহনের ভাণ করিয়া ১২৫ জন বাছা বাছা সৈন্যসহ জাবলী গেলেন।
ইহার তিন-চারি বৎসর আগে কৃষ্ণাজী মোরে, চন্দ্ররাও উপাধি লইয়া রাজা হইয়াছিলেন। রঘুনাথ প্রথম দিন সাধারণ ভদ্রতা ও আলাপের পর বাসায় ফিরিয়া আসিলেন, এবং চন্দ্ররাও-এর অসতর্ক অবস্থা বর্ণনা করিয়া নিজ প্রভুকে সৈন্য লইয়া জাবলীর কাছে উপস্থিত থাকিতে লিখিলেন, যেন খুনের পরে জাবলী আক্রমণ করিতে বিলম্ব না হয়। দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ গোপন-গৃহে হইল; রঘুনাথ আলোচনা আরম্ভ করিয়া দিয়া, হঠাৎ ছোরা খুলিয়া চন্দ্ররাও এবং তাঁহার ভাই সূর্য্য রাওকে হত্যা করিয়া ছুটিয়া ফটক দিয়া বাহির হইলেন; দ্বারপালগণ ভীত ও হতভম্ব হইয়া বাধা দিতে পারিল না; সৈন্যদের যাহারা তাড়া করিল তাহারা পরাস্ত হইয়া ফিরিয়া আসিল। রঘুনাথ বনে একটি নির্দিষ্ট স্থানে আসিয়া লুকাইলেন।
শিবাজী কাছেই ছিলেন। মোরেদের হত্যার সংবাদ পাইমাত্র তিনি জাবলী আক্রমণ করিলেন। নেতাহীন সৈন্যগণ ছয় ঘন্টা ধরিয়া সাহসের সহিত যুদ্ধ করিয়া অবশেষে দুর্গ ছাড়িয়া দিল (১৫ জানুয়ারী ১৬৫৬)। চন্দ্ররাও-এর দুই পুত্র ও পরিবারবর্গ বন্দী হইল। কিন্তু তাঁহার আত্মীয় ও কার্য্যাধ্যক্ষ হনুমন্ত রাও মোরে ঐ বংশের অনুচরদের একত্র করিয়া নিকটবর্তী একটি গ্রামে আত্মরক্ষা করিতে লাগিলেন। শিবাজী দেখিলেন, “হনুমন্তকে হত্যা না করিলে জাবলীর কন্টক দূর হইবে না।” তিনি শম্ভুজী কাবজী নামক এক মারাঠা-যোদ্ধাকে দৌত্যের ভাণ করিয়া হনুমন্তের নিকট পাঠাইলেন। কাবজী সাক্ষাতের সময় হনুমন্তকে খুন করিল। এইরূপে সমস্ত জাবলীপ্রদেশ শিবাজীর করতলগত হইল। তিনি এইবার দক্ষিণে কোলাপুর ও পশ্চিমে রত্নগিরি জেলা অধিকার করিবার সুযোগ পাইলেন। তাঁহার আরও এই একটি লাভ হইল যে, মাব্লে সৈন্য জুটাইবার ক্ষেত্র দ্বিগুণ বিস্তৃত হইল, কারণ এখন সাতারার পশ্চিম প্রান্তে ৬০ মাইল ব্যাপী পর্ব্বত ও উপত্যকা তাঁহার অধিকারে আসিল। মোরেদের সমস্ত সৈন্যসামন্ত এবং আট পুরুষের সঞ্চিত অগাধ ধনরত্ন তাঁহার হাতে পড়িল।
মোর বংশের কয়েকজন লোক ধরা পড়েন নাই, শিবাজীর উপর প্রতিশোধ লইবার জন্য তাঁহারা ১৬৬৫ সালে জয়সিংহের সহিত যোগ দিয়াছিলেন।
শিবাজীর নূতন দুর্গ
জাবলী গ্রামের দুই মাইল পশ্চিমে শিবাজী প্রতাপগড় নামে একটি দুর্গ নির্মাণ করিয়া তথায় ভবানী-মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করিলেন। কারণ, আদি ভবানী দেবীর মন্দির ছিল তুলজাপুরে, বিজাপুর-রাজ্যের মধ্যে। এই প্রতাপগড়ের ভবানীই শিবাজীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী হইলেন, তথায় তিনি অনেকবার তীর্থযাত্রা করেন এবং বহুমূল্য ধনরত্ন দান করেন।
জাবলীজয়ের পর শিবাজী রায়গড়ের বিশাল গিরিদুর্গ মোরের হাত হইতে কাড়িয়া লইলেন (এপ্রিল, ১৬৫৬); ইহা পরে তাঁহার রাজধানী হয়। ২৪এ সেপ্টেম্বর তিনি বৈমাত্রেয় মাতুল শম্ভুজীমোহিতের নিকট দশহরা পর্ব্বের প্রীতিউপহার চাহিবার ভাণ করিয়া গিয়া, তাঁহাকে হঠাৎ বন্দী করিলেন। শম্ভুজী শাহজীর আজ্ঞায় সুপে পরগণার শাসনকর্ত্তা ছিলেন; তিনি শিবাজীর অধীনে কার্য্য করিতে অস্বীকার করায় শিবাজী তাঁহাকে পিতার নিকট পাঠাইয়া দিয়া সুপে পরগণা দখল করিলেন।
৪ঠা নবেম্বর ১৬৫৬, বিজাপুরের সুলতান মুহম্মদ আদিল শাহর মৃত্যুতে যে বিপ্লবের আরম্ভ হইল, তাহা শিবাজীর পক্ষে মহা লাভের কারণ হইয়া দাড়াইল।
- পরে লোকের মুখে ঘটনাটি এই আকার ধারণ করে—“মালোজী বড় দেবদেবীভক্ত গৃহস্থ। একদিন মাঘ মাসের রাত্রে ক্ষেতে পাহারা দিতে দিতে তিনি দেখিলেন যে, মাটির তল হইতে শ্রীদেবী (অর্থাৎ শিবানী) আবির্ভূত হইলেন এবং নিজ জ্যোতির্ম্ময় অলঙ্কার-মণ্ডিত হাত তাঁহার মুখ ও পিঠে বুলাইয়া দিয়া বলিলেন, “বৎস। আশীর্ব্বাদ করিতেছি। এই গর্ত্তটি খুঁড়িলে সাত কড়াই-ভরা মোহর পাইবে। উহা আমি তোমাকে দান করিলাম। তোমার বংশে ২৭ পুরুষ পর্য্যন্ত রাজপদ চলিবে। তোমাদের সব বাঞ্ছা পূর্ণ হইবে।”
- এই শম্ভুজী যৌবনে কনকগিরি দুর্গ আক্রমণ করিতে গিয়া মারা যান। ইতিহাস তাঁহার সম্বন্ধে নীরব।
- দুই বৎসর পরে (১৬৬৯) জীজা বাঈ ও শিবাজী দাদাজীর সহিত শাহজীর নিকট বাঙ্গালোরে গেলেন। কিন্তু তিনি তাঁহাদের পুণায় ফিরিয়া পাঠাইয়া দিলেন।
- মারাঠী ভাষায় ‘মাবলনো (infinitive) ক্রিয়াপদ, অর্থ ‘অস্ত যাওয়া’। পর্ব্বত গাত্রের এই দেশকে উত্তরে (অর্থাৎ বগলানায়) ‘ডাঙ্গ’, মধ্যভাগে (অর্থাৎ নিজ মহারাষ্ট্রে) ‘মাবল’ এবং দক্ষিণ অর্থাৎ কর্ণাটকে ‘মল্লাঢ়’ বলা হয়।
- পুণা হইতে ২৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে।
০৩. মুঘল ও বিজাপুরের সহিত প্রথম যুদ্ধ
তৃতীয় অধ্যায় – মুঘল ও বিজাপুরের সহিত প্রথম যুদ্ধ
প্রথম মুঘল-রাজ্য আক্রমণ
১৬৫৬ সালের ৪ঠা নবেম্বর বিজাপুরের সুলতান মুহম্মদ আদিল শাহর মৃত্যু হইল, এবং অপরিণত-বুদ্ধি রাজকার্য্যে অনভ্যস্ত যুবক (দ্বিতীয়) আলী আদিল শাহ সিংহাসনে বসিলেন। তখন মুঘল-দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্ত্তা ছিলেন আওরংজীব। তিনি বিজাপুর অধিকার করিবার এই সুযোগ ছাড়িলেন না। আলী মৃত সুলতানের পুত্র নহেন—এই অপবাদ রটাইয়া তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন, এবং অন্যান্য বিজাপুরী জায়গীদারদের মত শিবাজীকেও লোভ দেখাইয়া মুঘল পক্ষে যোগ দিতে আহ্বান করিলেন। দুইজনের মধ্যে দেনা-পাওনা লইয়া চিঠিপত্র বিনিময় হইতে লাগিল। পরে শিবাজীর দূত সোনাজী পণ্ডিত বিদর-দুর্গের সামনে আওরংজীবের শিবিরে পৌছিলেন (মার্চ্চ ১৬৫৭), এবং তথায় দেনাপাওনার আলোচনায় এক মাস কাল কাটাইলেন। অবশেষে আওরংজীব শিবাজীর সব প্রার্থনা মঞ্জুর করিয়া তাঁহাকে মুঘল-সৈন্যদলে যোগ দিবার জন্য এক পত্র লিখিলেন (২৩ এপ্রিল)।