ঊনবিংশ শতাব্দীতে রচিত মারাঠী গ্রন্থে প্রকাশ মুদ্হোল গ্রামের জাগীরদার বাজী রাও ঘোরপড়ে মুস্তাফা খাঁর ইঙ্গিতে নিমন্ত্রিত শাহজীকে নিজ শিবিরে আনিয়া বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তাঁহাকে কয়েদ করেন। এই অপরাধের প্রতিশোধ লইবার কয়েক বৎসর পরে শাহজী শিবাজীকে আজ্ঞা দিয়া এই মুদ্হোলের ঘোরপড়ে বংশ প্রায় উচ্ছেদ করান। কিন্তু বিশেষ বিশ্বাসযোগ্য ফারসী-ইতিহাস “বুসাতীন্-ই সলাতীন্” হইতে আমরা জানিতে পারি যে গল্পটি সত্য নহে; শাহজীকে কয়েদ করিবার প্রণালী এইরূপ—“শাহজীর অবাধ্যতায় নবাব মুস্তাফা খাঁ তাঁহাকে গেরেফ্তার করা স্থির করিয়া, একদিন বাজীরাও ঘোরপড়ে ও যশোবন্ত রাও (আসদ্খানী)-কে নিজ নিজ সৈন্য সজ্জিত করিয়া অতি প্রত্যুষে শাহজীর শিবিরের দিকে পাঠাইলেন। শাহজী সারা রাত্রি নাচগান উপভোগ করিয়া ভোরে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন। এই দুই রাও-এর আগমন ও উদ্দেশ্য জানিতে পারিয়া হতভম্ব হইয়া ঘোড়ায় চড়িয়া শিবির হইতে একাকী পলাইতে লাগিলেন। বাজী রাও পিছু পিছু ঘোড়া ছুটাইয়া তাঁহাকে বন্দী করিয়া নবাবের সম্মুখে হাজির করিলেন। •••আদিল শাহ সংবাদ পাইয়া বন্দীকে রাজধানীতে আনিবার জন্য আফজল খাঁকে, এবং তাঁহার সম্পত্তি বুঝিয়া লইবার জন্য একজন খোজাকে জিঞ্জিতে পাঠাইলেন।” বিজাপুরে শাহজীকে আনিয়া কিছুদিন সেনাপতি আহমদ খাঁর বাড়ীতে কারাবদ্ধ রাখা হইল।
শাহজীর কারামুক্তি
শিবাজী মহা বিপদে পড়িলেন; পিতাকে বাঁচাইতে হইলে তাঁহাকে বিজাপুর সুলতানের বাধ্যতা স্বীকার করিতে হইবে, আর এই বশ্যতার ফলে নুতন জয়-করা সমস্ত রাজ্য ফিরাইয়া দিতে হইবে—এত পরিশ্রম সব পণ্ড হইবে। সুতরাং দুইদিক রক্ষা করিবার জন্য তিনি রাজনীতির কূট চাল চালিলেন। প্রবল পরাক্রমশালী মুঘল-সম্রাট বিজাপুরের শত্রু, বিজাপুররাজ তাঁহার আজ্ঞা অমান্য করিতে সাহস করেন না। অতএব শিবাজী নিকটবর্ত্তী মুঘল-শাসনাধীন দাক্ষিণাত্য-প্রদেশের শাসনকর্ত্তা যুবরাজ মুরাদ বখ্শকে দরখাস্ত করিলেন যে, যদি বাদশাহ শাহজীর পূর্ব্ব অপরাধ (অর্থাৎ ১৬৩৩-৩৬ পর্যন্ত বাদশাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা) ক্ষমা করেন এবং ভবিষ্যতে শাহজী ও তাঁহার পুত্রগণকে রক্ষা করিতে সম্মত হন, তবে যুবরাজ অভয়-পত্র পাঠাইলে শিবাজী গিয়া মুঘল-সৈন্যদলে চাকরি করিবেন। কয়েকমাস ধরিয়া চিঠি লেখালেখি এবং দূত-প্রেরণের পর ১৬৪৯ সালের ৩০ নভেম্বর মুরাদ শিবাজীকে জানাইলেন যে, তিনি শীঘ্রই বাদশাহর নিকট যাইবেন এবং তথায় সাক্ষাতে শিবাজীর প্রার্থনা নিবেদন করিয়া সম্রাটের হুকুম লইবেন। এইরূপে এক বৎসর নষ্ট হইল। ইতিহাস হইতে বোঝা যায় যে, বাদশাহ শিবাজীর প্রার্থনায় কর্ণপাত করেন নাই। বিজাপুর-রাজ্যের সেনাপতি আহমদ খাঁর অনুরোধে এবং বাঙ্গালোর, কোণ্ডানা ও কন্দর্পী এই তিনটি দুর্গ সমর্পণ করিবার ফলস্বরূপ আদিল শাহ শাহজীকে মুক্ত করিলেন (১৬৪৯ সালের শেষে)। তাহার পর কিছুকাল তিনি মহীশূরের বিদ্রোহী জমিদার (পলিগর)গণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়া তাহাদের পুনরায় বিজাপুরের অধীনে আনেন এবং তথায় ও মাদ্রাজ অঞ্চলে বিজাপুরের ওমরা-স্বরূপ জাগীর পান।
শাহজী জামিনে খালাস পান; সুতরাং পিতা পাছে আবার বিপদে পড়েন, এই ভাবিয়া শিবাঙ্গী ১৬৫০ হইতে ১৬৫৫ পর্যন্ত শান্তভাবে কাটান, বিজাপুর সরকারকে কোনমতে ক্ষুণ্ন করেন নাই।
কিন্তু এই সময়ে তিনি পুরন্দর দুর্গ হস্তগত করেন। এটি “নীলকণ্ঠ নায়ক” উপাধিধারী এক ব্রাহ্মণ পরিবারের জাগীর ছিল। এসময়ে নীলোজী, শঙ্করাজী ও পিলাজী নামক তিন ভাই একান্নভুক্ত শরিকরূপে উহার মালিক ছিলেন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা নীলোজী বড় কৃপণ ও স্বার্থপর, তিনি অপর দুই ভাইকে তাহাদের ন্যায্য প্রাপ্য আয় ও ক্ষমতা দিতেন না। পৈত্রিক সম্পত্তি বিভাগ করিয়া দিবার জন্য তাহারা মনের দুঃখে শিবাজীকে ধরিয়া পড়িল। শিবাজীর সহিত এই পরিবারের দুই-তিন পুরুষের হৃদ্যতা ছিল, এবং পুরন্দর পুণা হইতে মাত্র নয় ক্রোশ দূর। শিবাজী দেওয়ালীর সময় অতিথিরূপে দুর্গে প্রবেশ করিলেন। তৃতীয় দিবসে কনিষ্ঠ দুই ভাই রাত্রে জ্যেষ্ঠকে বাঁধিয়া শিবাজীর নিকট আনিল, আর শিবাজী তিনজনকেই বন্দী করিয়া দুর্গটি নিজে দখল করিলেন ও তথায় মাব্লে-সৈন্য বসাইলেন। কিন্তু কিছুদিন পরে তাহাদের ভরণপোষণের জন্য চাম্লী নামক গ্রাম দান করিলেন, এবং পিলাজীকে নিজ সৈন্যদলে চাকরি দিলেন।
শিবাজীর জাবলী-অধিকার
সাতারা জেলার উত্তর-পশ্চিম কোণে বিখ্যাত মহাবালেশ্বর পর্ব্বতের পাঁচ-ছয় মাইল পশ্চিমে জাবলী গ্রাম। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমে মোরে নামক এক মারাঠা-বংশ বিজাপুরের প্রথম সুলতানের নিকট হইতে জাবলী পরগণা জাগীর স্বরূপ পান এবং ক্রমে পাশের জমি দখল করিয়া প্রায় সমগ্র সাতারা জেলা এবং কোঁকনের কিছু কিছু অংশে নিজ রাজ্য স্থাপন করেন। প্রথম মোরে স্বহস্তে বাঘ বধ করায় বিজাপুররাজ তাঁহার বীরত্বের জন্য “চন্দ্ররাও” উপাধি দেন; এই উপাধি পুরুষানুক্রমে মোরেদের জ্যেষ্ঠপুত্র ভোগ করিতেন। কনিষ্ঠ ভাইগণকে নিকটবর্ত্তী গ্রাম দেওয়া হইত।
আট পুরুষ ধরিয়া যুদ্ধ ও লুঠ করিবার ফলে মোরেদের ভাণ্ডারে অনেক ধনরত্ন সঞ্চিত হইয়াছিল। তাহাদের অধীনে বারো হাজার পদাতিক সৈন্য ছিল, ইহারা মাব লেদের জাতভাই, বলবান সাহসী পার্ব্বতীয় সেনা। ফলতঃ তখন জাবলী-রাজ্য বলিতে প্রায় সমস্ত সাতারা জেলা বুঝাইত। ইহার পশ্চিম দিকে খাড়া সহ্যাদ্রি পর্ব্বত, সমুদ্র হইতে ৪,০০০ ফিট উঁচু, তাহার পূর্ব্ব পাশের উপত্যকাগুলি ঘন বনজঙ্গল ও বিক্ষিপ্ত পাথরে আচ্ছন্ন; এই বৃক্ষ-প্রস্তরময় প্রদেশ পশ্চিমে ৬০ মাইল বিস্তৃত, তাহা ভেদ করিয়া ওধারে কোঁকনে যাইবার পথে আটটি গিরিসঙ্কট আছে; দুইটি এমন প্রশস্ত যে তাহা দিয়া গরুরগাড়ী চলিতে পারে।