শিবাজী স্বাধীন জীবন চান
দাদাজী ও অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ যে রামায়ণ মহাভারত ও শাস্ত্র পাঠ করিতেন তাহা শুনিয়া শুনিয়া শিবাজীর তরুণ হৃদয় গঠিত হইল। সন্ন্যাসিনীতুল্য মাতার দৃষ্টান্ত দেখিয়া এবং তাঁহার উপদেশ পাইয়া শিবাজীর মনে সাত্ত্বিক ভাব, দৃঢ়তা ও ধর্ম্মপ্রাণতা জন্মিল। স্বাধীন জীবনের জন্য তাঁহার মন ব্যাকুল হইল; কোন মুসলমান-রাজার অধীনে সেনাপতি হইয়া অর্থ ও সুখ আকাঙ্ক্ষা করাকে তিনি দাসত্ব বলিয়া ঘৃণা করিতে শিখিলেন। স্বাধীন রাজা হওয়া তাঁহার জীবন-প্রভাতের একমাত্র ইচ্ছা ছিল, সমগ্র হিন্দুজাতিকে উদ্ধার বা রক্ষা করার ইচ্ছা অনেক পরে তাঁহার মনে স্থান পায়।
শিবাজী বড় হইলে কোন পথে চলিবেন—এই প্রশ্ন লইয়া অভিভাবকের সঙ্গে তাঁহার মতের অমিল হইল। দাদাজী কোণ্ডদেব বিচক্ষণ জমিদারী দেওয়ান ও ধার্ম্মিক গৃহস্থ; তাঁহার কোন উচ্চ আকাঙ্ক্ষা, মহৎ আদর্শ বা দুর ভবিষ্যতে দৃষ্টি ছিল না। তিনি শিবাজীকে বার বার বলিতে লাগিলেন যে, পিতৃ-পিতামহের মত কোন মুসলমান-রাজার মন্সব্দার হইয়া সৈন্য লইয়া তাঁহার আজ্ঞা পালনের দ্বারা জাগীর অর্থ উপাধি লাভ করাই ভাল; বনজঙ্গলে ঘুরিয়া ডাকাতদের সঙ্গে মিশিলে, ইচ্ছা করিয়া বিপদ ও গোলমালের মধ্যে গেলে, অথবা স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের চেষ্টা করিলে, পরিণাম শোচনীয় হইবে। শিবাজী শুনিলেন না; শাহজীর নিকট দাদাজী নালিশ করিলেন, কিন্তু পিতার নিষেধে কোনই ফল হইল না। দুশ্চিন্তায় ও মনঃকষ্টে বৃদ্ধ দাদাজী প্রাণত্যাগ করিলেন (১৬৪৭) এবং বিশ বৎসর বয়সে শিবাজী নিজেই নিজের কর্ত্তা হইলেন।
যুবক শিবাজীর প্রথম স্বাধীন কাজ
ইতিমধ্যে শিবাজী যুদ্ধবিদ্যা এবং জমিদারী-চালান সম্পূর্ণরূপে শিখিয়াছিলেন, এবং ঐ প্রদেশের প্রজা ও সৈন্যগণের সহিত বিশেষভাবে পরিচিত হইয়াছিলেন। নিজের বুদ্ধিতে কাজ করিতে এবং লোককে অধীনে রাখিতে ও খাটাইতে তাঁহার অভ্যাস হইয়াছিল। তাঁহার বর্ত্তমান কর্ম্মচারিগুলি বিশ্বস্ত ও কার্য্যদক্ষ, শ্যামরাজ নীলকণ্ঠ রাঞ্ঝেকর ছিলেন পেশোয়া বা দেওয়ান, বালকৃষ্ণ দীক্ষিত ছিলেন মজমুয়াদার (হিসাব-লেখক), সোণাজী পন্ত দবীর (বা পত্রলেখক) এবং রঘুনাথ বল্লাল কোর্ডে সবনীস্ অর্থাৎ সৈন্যদের বেতন-কর্ত্তা। ইঁহাদের শাহজী আগে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।
১৬৪৬ সালে বিজাপুর রাজ্যে দুর্দিন দেখা দিল। রাজা মুহম্মদ আদিল শাহ অনেককাল গৌরবে রাজ্যশাসন এবং দেশবিজয় করিবার পর শয্যাশায়ী হইয়া পড়িলেন। তাঁহার জীবনসংশয় হইল। তিনি ইহার পর আরও দশ বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন বটে, কিন্তু তাহা অর্ধমৃত জড় অবস্থায়। সাধারণ লোকেরা বলিত যে, সাধু ফকীর শাহ হাসিম উলুবী মন্ত্রবলে নিজ জীবনের দশ বৎসর পরমায়ু রাজাকে দান করেন, সেই ধার-করা প্রাণ লইয়া বাজা এই দশ বৎসর কোনক্রমে বাঁচিয়া ছিলেন। এই কয় বৎসর রাজা অচল, পুতুলের মত; রাণী বড়ি সাহিবা শাসনকার্য্য চালাইতে লাগিলেন, রাজ্যের কেন্দ্রে জীবনীশক্তি রহিল না।
ইহাই ত শিবাজীর পরম সুযোগ। এই বৎসর তিনি বাজী পাসলকর যেসাজী কঙ্ক এবং তানাজী মালুসরেকে কতকগুলি মাব্লে পদাতিকের সহিত পাঠাইয়া বিজাপুর-রাজার পক্ষের কিলাদার (দুর্গস্বামী)-কে ভুলাইয়া তোরণা[৫]দুর্গ দখল করিলেন। এখানে দুই লক্ষ হোণ রাজার খাজনা জমা হইয়াছিল, তাহা শিবাজীর হাতে পড়িল। তোরণার পাঁচ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব্বে ঐ পর্ব্বতের অপর এক চূড়ায় তিনি রাজগড় নামক একটি নূতন দুর্গ গড়িলেন, এবং তাহার নীচে ক্রমান্বয়ে তিনটি স্থানে জমি সমান করিয়া দেওয়াল দিয়া ঘিরিয়া ‘মাচী’, অর্থাৎ রক্ষিত গ্রাম নির্ম্মাণ করিলেন।
প্রথম রাজ্য বিস্তার
দাদাজী কোণ্ডদেবের মৃত্যুর পর (১৬৪৭) শিবাজী সর্ব্বপ্রমে পিতার ঐ প্রদেশস্থ সমস্ত জাগীর হস্তগত করিয়া একটি সংলগ্ন একচ্ছত্র রাজ্যস্থাপন করিতে চেষ্টা করিলেন। পূণার ১৮ মাইল উত্তরে চাকন দুর্গের অধ্যক্ষ ফিরঙ্গ জী নরসালা শিবাজীকে প্রভু বলিয়া স্বীকার করিলেন; বারামতী ও ইন্দাপুর নামক দক্ষিণ-পূর্ব্বদিকের দুইটি ছোট থানার কর্ম্মচারিগণও শিবাজীর অধীনে আসিল।
তাহার পর শিবাজী বিজাপুর-রাজ্য হইতে দেশ কাড়িয়া লইয়া নিজ অধিকার-সীমা বাড়াইতে লাগিলেন। পুণার ১১ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে কোণ্ডানা দুর্গ বিজাপুর-রাজার ছিল; ইহার কিলাদার ঘুষ লইয়া দুর্গটি শিবাজীর হাতে ছাড়িয়া দিল।
শাহজী বিজাপুরে বন্দী
১৬৪৮ সালের মাঝামাঝি শিবাজী এতদুর পর্য্যন্ত অধিকার বিস্তার করিয়া ফেলিলেন। কিন্তু ঠিক সেই সময় এক নূতন বিপদ আসিয়া তাঁহাকে বাধা দিল। ২৫এ জুলাই তাঁহার পিতা শাহজী বিজাপুরসেনাপতি মুস্তাফা খাঁর আজ্ঞায় জিঞ্জি দুর্গের বাহিরে কারারুদ্ধ হইলেন; তাঁহার সম্পত্তি ও সৈন্য রাজসরকারে জব্ত করা হইল। অনেক পরে রচিত ইতিহাসে এই ঘটনার কারণ মিথ্যা করিয়া লেখা হইয়াছে যে, বিজাপুরের সুলতান শিবাজীকে দমন করিবার জন্য শাহজীকে কয়েদ করেন, এবং শিবাজী বশ না মানিলে শাহজীর কারাদ্বার ইট গাঁথিয়া বন্ধ করিয়া তাঁহাকে জীবন্ত গোর দেওয়া হইবে, এরূপ শাসান। কিন্তু সমসাময়িক সরকারী ফারসী-ইতিহাস (জহর বিন্ জহুরীকৃত মহম্মদ আদিল শাহের রাজত্ব-বিবরণ) হইতে জানা যায়, বিজাপুরী সৈন্যগণ যখন বহদিন যুদ্ধ করিয়াও জিঞ্জি দুর্গ লইতে পারিল না, তাহাদের অন্নকষ্ট উপস্থিত হইল, তখন শাহজী প্রধান সেনাপতির নিষেধ অগ্রাহ করিয়া সসৈন্য রণত্যাগ করিয়া নিজ জাগীরে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। সর্বোচ্চ সেনাধ্যক্ষ নবাব মুস্তাফা খাঁ দেখিলেন, দুর্গ-অবরোধ ত একেবারে পণ্ড হইয়া যায়, অথচ শাহজীর পলায়নে বাধা দিলে নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি আরম্ভ হইবে। তখন তিনি বুদ্ধি করিয়া বিনাযুদ্ধে শাহজীকে বন্দী করিলেন; তাহার সমস্ত সম্পত্তি জব্ত করিলেন,— এক কণামাত্র গোলমালে লুঠ হইতে পারিল না।