সৈন্য-বিভাগের বন্দোবস্তে-শৃঙ্খলা, দূরদর্শিতা, সব বিষয়ের সূক্ষ্ণাংশের প্রতিদৃষ্টি, স্বহস্তে কর্মের নানা সূত্র একত্র ধরিবার ক্ষমতা, প্রকৃত চিন্তাশক্তি এবং অনুষ্ঠান-নৈপুণ্য—এই সকল গুণের তিনি পরাকাষ্ঠা দেখান। দেশের প্রাকৃতিক অবস্থার ও তাহার সৈন্যগণের জাতীয় স্বভাবের উপযোগী কোন্ প্রণালীর যুদ্ধ সর্বাপেক্ষাফলপ্রদ হইবে, নিরক্ষর শিবাজী শুধু প্রতিভার বলেই তাহা আবিষ্কার ও অবলম্বন করেন।
শিবাজীর প্রতিভা যে কত মৌলিক, কত বড়, তাহা বুঝিতে হইলে মনে রাখিতে হইবে যে তিনি মধ্যযুগের ভারতে এক অসাধ্য সাধন কেন। তাহার আগে কোন হিন্দই মধ্যাহ্ন-সূর্যের মত প্রখর দীপ্তিশালী শক্তিমান মুঘল-সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দাড়াইতে সমর্থ হয় নাই; সকলেই পরাজিত নিষ্পেষিত হইয়া লোপ পাইয়াছিল। তাহা দেখিয়াও এই সাধারণ জাগীরদারের পুত্র ভয় পাইল না, বিদ্রোহী হইল, এবং শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করিল। ইহার কারণ—শিবাজীর চরিত্রে সাহস ও স্থির চিতার অপূর্ব সমাবেশ হইয়াছিল; তিনি নিমিষে বুঝিতে পারিতেন, কোন ক্ষেত্রে কতদুর অগ্রসর হওয়া উচিত, কোথায় থামিতে হইবে-সময় কোন নীতি অবলম্বন করা শ্রেয়,—এই লোক ও অর্থবলে ঠিক কি কি করা সম্ভব। ইহাই সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতিভার পরিচায়ক। এই কার্যদক্ষতা ও বিষয়-বন্ধিই তাঁহার জীবনের আশ্চর্য সফর সবপ্রধান কারণ।
শিবাজীর রাজ্য লোপ পাইয়াছে; তাহার বংশধরগণ আজ জমিদার মাত্র। কিন্তু মারাঠা জাতিকে নবজীবন দান তাঁহার অমর কীর্তি। তাহার জীবনের চেষ্টার ফলে সেই বিক্ষিপ্ত পরাধীন জাতি এক হইল, নিজ শক্তি বুঝিতে পারিল, উন্নতির শিখরে পেীছিল। ফলত, শিবাজী হিন্দু জাতির সর্বশেষ মৌলিক গঠন-কর্তা এবং রাজনীতি ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ কর্মবীর। তাহার শাসন-পদ্ধতি, সৈন্য-গঠন, অনুষ্ঠান-চনা সবই নিজের সৃষ্টি। রণজিৎ সিংহ বা মাহাদী সিন্ধিয়ার মত তিনি ফরাসী সেনাপতি বা শাসনকর্তার সাহায্য লন নাই। তাহার রাজ্য-ব্যবস্থা দীর্ঘকাল স্থায়ী হইয়াছিল, এবং পেশোয়াদের সময়েও আদর্শ বলিয়া গণ্য হইত।
নিরক্ষর গ্রাম্য বালক শিবাজী কত সামান্য সম্বল লইয়া, চারিদিকে কত বিভিন্ন পরাক্রান্ত শত্রুর সঙ্গে মুখিয়া, নিজেকেসঙ্গে সঙ্গে সময় মারাঠা জাতিকে—স্বাধীনতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন, তাহা এই গ্রন্থে বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা হইয়াছে। সেই আদি যুগের পাল সাম্রাজ্যের পর শিবাজী ভিন্ন অপর কোন হিন্দুই এত উচ্চশ্রেণীর ক্ষমতা দেখাইতে পারেন নাই।
একতাহীন, নানা রাজ্যে বিচ্ছিন্ন, মুসলমান রাজার অধীন, এবং পরের চাকর মারাঠাদের ডাকিয়া আনিয়া শিবাজী প্রথমে নিজ কার্যের দ্বারা দেখাইয়া দিলেন যে তাহারা নিজেই নিজের প্রভু হইয়া যুদ্ধ করিতে পারে। তাহার পর, স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করিয়া তিনি প্রমাণ করিলেন যে বর্ত্তমান কালের হিন্দুরাও রাষ্ট্রের সব বিভাগের কাজ চলাইতে পারে; শাসন-প্রণালী গড়িয়া তুলিতে, জলে-স্থলে যুদ্ধ করিতে, দেশে সাহিত্য ও শিল্প পুষ্টি করিতে, বাণিজ্য-পোত গঠন ও পরিচালন করিতে, ধর্ম্মরক্ষা করিতে, তাহারা সমর্থ; জাতীয় দেহকে পূর্ণতা দান করিবার শক্তি তাহাদের আছে।
শিবাজীর চরিত-কথা আলোচনা করিয়া আমরা এই শিক্ষা পাই যে, প্রয়াগের অক্ষয় বটের মত হিন্দুজাতির প্রাণ মৃত্যুহীন, কত শত বৎসরের বাধা-বিপত্তির ভার ঠেলিয়া ফেলিয়া আবার মাথা তুলিবার, আবার নুতন শাখাপল্লব বিস্তার করিবার শক্তি তাহাদের মধ্যে নিহিত আছে। ধর্ম্মরাজ্য স্থাপন করিলে, চরিত্রবলে বলীয়ান হইলে, নীতি ও নিয়মানুবর্তিতাকে অন্তরের সহিত মানিয়া লইলে, স্বার্থ অপেক্ষা জন্মভূমিকে বড় বিশে, বাগাড়ম্বর অপেক্ষা নীরব কার্য্যকে সাধনার লক্ষ্য করিলে,জাতি অমর আজেয় হয়।
সমাপ্ত
- একজন বাঙ্গালী কবি সংস্কৃতে বগীদিগকে “কৃপায় কৃপণ, গর্ভবতী ও শিশুর পীড়ক” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন (১৭৪৩ সাল)।