পঞ্চম কারণ-অর্থনৈতিক অবনতি
মারাঠা-শাসনের প্রধান দোষ ছিল অর্থনীতির অবহেলা। কৃষিবাণিজ্যের উন্নতি, প্রজা ও দোকানদারদিগকে অত্যাচার হইতে রক্ষা ও ঘুষ বন্ধ করা, সুনিম্মিত ও সুরক্ষিত পথঘাট, বিচারালয়ে বিবাদের সত্বর সুবিচার, স্থায়িভাবে দেশের ধন-বৃদ্ধি এবং তাহার দ্বারা রাজ্যের শক্তির উন্নতি,—ইহার কোনটির দিকেই রাজা-উজারের দৃষ্টি ছিল না। তাহাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল “মুলুগিরি” অর্থাৎ পর-রাজ্য লুঠ করিয়া ধন-দৌলত আনা; তাহাতেই তাহাদের সমস্ত চিন্তা, সমস্ত চেষ্টা, সমস্ত লোকবল ব্যয় হইত। ইহার ফলে মারাঠারা অন্য সব লোকের-হিন্দু মুসলমান, রাজপুত জাঠ, কানাড়ী বাঙ্গালী,—দক্ষিণ প্রাপ্ত হইতে উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত সমগ্র ভারত জুড়িয়া রাজা-প্রজার, পীড়ক[১]ও শত্রু হইল, – জগতে এক জনও বন্ধ রাখিল না। এই অন্ধ ও অসৎ রাজনীতি অনুসরণের ফলে মারাঠাদের পতনের জন্য সকলেই ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিল। আর, তাহাদেরবারংবার লুণ্ঠনের ফলে দেশের সর্বত্রই ধনাগম বন্ধ হইল, কৃষি বাণিজ্যে দ্রুত অবনতি হইতে লাগিল, অনেক উর্বর ক্ষেত্র জঙ্গলে পরিণত এবং সমৃদ্ধ শহর দন্ধ ভগ্ন জনহীন হইল; লোকে অর্থ সঞ্চয় করিবার, অর্থ বুদ্ধি করিবার চেষ্টা ছাড়িয়া দিল। শেষে এমন হইল যে মারাঠারা আসিয়া পূর্বের চৌথের দশমাংশও পাইত না। কেবলমাত্র রাজ্য-লুঠের বলে যে জাতি বলীয়ান হইবার চেষ্টা করে তাহার অর্থবল এইরূপ মরীচিকা মাত্র।
ষষ্ঠ কারণ—সত্যপ্রিয়তার ও রাষ্ট্রীয় বলের অভাব
মারাঠাদের মধ্যে বীর ও যোদ্ধা অনেক ছিল বটে, কিন্তু তাহাদের নেতারা রাজনীতির ক্ষেত্রে কৌশল ও প্রতারণাই বেশী অবলম্বন কবিতেন। তাহা বুঝিতেন না যে, মিথ্যা কথা দু’একবাব চলে চিরকাল চলে না। কথা রক্ষা না করিলে, বিশ্বাসঘাতক হইলে, সত্য ব্যবহার না করিলে, কোন রাজাই টিকিতে পাবে না। মারাঠা সেনাপতি ও মন্ত্রী লাভের সুযোগ পাইলেই সন্ধি ভঙ্গ করিতেন, নিজ কথাব বিপরীত আচরণ করিতেন—ইহাতে কিছুমাত্র লজ্জিত হইতেন না। কেহই তাহাদের উপর নির্ভব করিতে, বিশ্বাস করিতে পারিত না।
রাজ্য রক্ষা করিতে হইলে যুদ্ধ ও (কৗশল (ডিপ্লোম্যাসি) দুই-ই আবশ্যক, এবং যুদ্ধও সময় বুঝিয়া, পূর্ব প্রস্তুত হইয়া, করা উচিত। কিন্তু মারাঠা রাজনীতি ছিল প্রত্যেক বৎসর কোন-না কোন প্রদেশে অভিযান পাঠান। এই বাৎসরিক যুদ্ধ কিছু অর্থ লাভ হইত বটে, কিন্তু সৈন্যনাশ ও শত্রুবৃদ্ধি হইয়া তদপেক্ষা অধিক ক্ষতি করিত। এই সব দুরদৃষ্টিহীন অভিযান এবং কূট পররাষ্ট্র নীতি ও ষডযন্ত্র অনুসবণের ফলে মারাঠা রাজশক্তি ক্রমেই দুর্বল হইয়া পডিতে লাগিল। আর সেই সময় সুদক্ষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বিদেশী বণিকেরা স্থিরবুদ্ধিতে পদে পদে অগ্রসর হইযা, ক্রমশঃ নিজ শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি কবিয়া, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ভারতের সাধ্বভৌম প্রভু হইল, মারাঠা জাতি ইংরাজের অধীন হইল। ইহা প্রকৃতির অনিবার্য্য বিধান।
শিবাজীর চরিত্র মারাঠাদের গৌরব যে-সময়েই শেষ হউক না কেন, শিবাজী তাহায় জন্য দায়ী নহেন; এই জাতীয় পতন তাহার কীর্তি ম্লান করে নাই, বরং বিপরীত দৃষ্টান্ত দেখাইয়া উজ্জ্বলতর করিয়া তুলিয়াছে। তাহার চরিত্র নানা সদ্গুণে ভূষিত ছিল। তার মাতৃভক্তি, সন্তানপ্রীতি, ইন্দ্রিয়-সংযম, ধর্ম্মানুরাগ, সাধুসন্তের প্রতি ভক্তি, বিলাস-বর্জন, শ্রমশীলতা, এবং সর্ব্ব সম্প্রদায়ের প্রতি উদারভাব সে যুগে অন্য রাজবংশে কেন, অনেক গৃহস্থঘরেও অতুলনীয় ছিল। রাজা হইয়া তিনি রাজ্যের সমস্ত শক্তি দিয়া স্ত্রীলোকের সতীত্বরক্ষা, নিজ সৈন্যদলের উজ্জ্বলতা দমন, সর্ব্ব ধর্মের মন্দির ও শাস্ত্রগ্রন্থের প্রতি সম্মান এবং সাধুসজ্জনের পোষণ করিতেন।
তিনি নিজে নিষ্ঠাবান ভক্ত হিন্দু ছিলেন, ভজন ও কীর্ত্তন শুনিবার জন্য অধীর হইতেন, সাধু-সন্ন্যাসীর পদসেবা করিতেন, গোব্রাহ্মণের পালক ছিলেন। অথচ, যুদ্ধ-যাত্রায় কোথাও একখানি কোরাণ পাইলে তাহা নষ্ট বা অপবিত্র না করিয়া সযত্নে রাখিয়া দিতেন এবং পরে কোন মুসলমানকে তাহা দান করতেন; মসজিদ ও ইসলামী মঠ (খাকা) দেখিলে তাহা আক্রমণ না করিয়া ছাড়িয়া দিতেন। গোড়। মুসলমান ঐতিহাসিক খাফি খাঁ শিবাজীর মৃত্যুর বর্ণনায় লিখিয়াছেন, “কাফির জেহন্নমে গেল”; কিন্তু তিনিও শিবাজীর সৎ চরিত্র, পরস্ত্রীকে মাতার সমান জ্ঞান, দয়া-দাক্ষিণ্য এবং সর্ব্ব ধর্ম্মে সমান সম্মান প্রভৃতি দুর্লভ গুণের মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করিয়াছেন। শিবাজীর রাজ্য ছিল “হিন্দবী স্বরাজ”, অথচ অনেক মুসলমান তাহার অধীনে চাকরি পাইয়াছিল [দৃষ্টান্তের জন্য আমার ইংরাজী শিবাজীর ৩য় সংস্করণের ৪০২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য]।
সর্ব্ব জাতি, সর্ব ধর্ম-সম্প্রদায়, তাঁহার রাজ্যে নিজ নিজ উপাসনার স্বাধীনতা এবং সংসারে উন্নতি করিবার সমান সুযোগ পাইত। দেশে শান্তি ও সুবিচার, সুনীতির জয় এবং প্রজার ধনমান রক্ষা হাই দান। ভারতবর্ষের মত নানা বর্ণ ও ধর্মের লোক লইয়া গঠিত দেশে, শিবাজীর অনুসৃত এই রাজনীতি অপেক্ষা অধিক উদার ও শ্রেয় কিছুই কল্পনা করা যাইতে পারে না।
শিবাজীর প্রতিভা ও মৌলিকতা
লোক দেখিবামাত্র তাহাদের চরিত্র ও ক্ষমতা ঠিক বুঝিয়া, প্রত্যেককে তাহার যোগ্যতার অনুযায়ী কাজে নিযুক্ত করাই প্রকৃত বাজার গুণ। শিবাজীর এই আশ্চর্য গুণ ছিল। আর, তাহার চরিত্রের আকর্ষণী-শক্তি ছিল চুম্বকের মত-দেশের যত সৎ লক্ষ মহৎ লোক তাহার নিকট আসিয়া জুটিত; তাহাদের সহিত বন্ধুভাবে ব্যবহার করি, তাহাদের সন্তুষ্ট রাখিয়া, তাহাদের নিকট হইতে তিনি আন্তরিক ভক্তি এবং একান্ত বিশ্বাস ও সেবা লাভ করিতেন। এইজন্যই তিনি সর্বদা সন্ধি-বিগ্রহে, শাসন ও রাজনীতিতে এত সফল হন। সৈনাদের সঙ্গে সদাসর্বদা মিলিয়া মিশিয়া, তাহাদের দুঃখ-কষ্টের ভাগী হইয়া ফরাসী সৈন্যমধ্যে নেপোলিয়নের ন্যায় তিনি একাধারে তাহাদের বন্ধু ও উপাস্য দেবতা হইয়া পড়েন।