প্রাধান্য লোপ পাইয়া, তাহাদের আবার বিজাতির পদানত হইতে হইয়াছে, তবুও তাহাদের চৈতন্য হয় নাই, তাহাদের মধ্যে এই জাতে নাতে বিবাদ আজও চলিয়াছে-জাতিভেদের বিষ এতই ভীষণ। রবীন্দ্রনাথ সত্যই বলিয়াছেন-“শিবাজী যে হিন্দুসমাজকে মোঘল আক্রমণের বিরুদ্ধে জয়মুক্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, আচারবিচারগত বিভাগ-বিচ্ছেদ সেই সমাজের একেবারে মূলের জিনিষ। সেই বিভাগমূলক ধসমাজকেই তিনি সমস্ত ভারতবর্ষে জয়ী করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। ইহাকেই বলে বালির বাঁধ বাঁধা—ইহাই অসাধ্য সাধন।
“শিবাজী এমন কোনো ভাবকে আশ্রয় ও প্রচার করেন নাই যাহ। হিন্দু-সমাজের মূলগত ছিদ্রগুলিকে পরিপূর্ণ করিয়া দিতে পারে। নিজের ধর্ম বাহির হইতে পীড়িত অপমানিত হইতেছে এই ক্ষোভ মনে লইয়া তাহাকে ভারতবর্ষের সর্বত্র বিজয়ী করিবার ইচ্ছা স্বাভাবিক হইলেও তাহা সফল হইবার নহে; কারণ ধর্ম যেখানে ভিতর হইতেই পীড়িত হইতেছে, যেখানে তাহার ভিতরেই এমন সকল বাধা আছে যাহাতে মানুষকে কেবলি বিচ্ছিন্ন ও অপমানিত করিতেছে, সেখানে সেদিকে দৃষ্টিপাত মাত্র না করিয়া, এমন কি, সেই ভেদবুদ্ধিকেই মুখ্যতঃ ধর্ম্মবুদ্ধি বলিয়া জ্ঞান করিয়া, সেই শতদীর্ণ ধর্ম্মসমাজের স্বরাজ্য এই সুবৃহৎ ভারতবর্ষে স্থাপন করা কোনো মানুষেরই সাধ্যায়ত্ত নহে, কারণ তাহা বিধাতার বিধানসঙ্গত হইতে পারে না।”
দ্বিতীয় কাবণ-নেশন-গঠনের চেষ্টার অভাব
মারাঠা-প্রাধান্যের সময় নেশনের শিক্ষা ও অর্থবল, একতা ও সঙ্ঘবদ্ধ উদ্যম বৃদ্ধি কবিবার কথা স্থিরমনে ভাবা হইত না, তাহার জন্য দৃঢ় চেষ্টা হইত না; সব লোক নির্বিচারে পূর্বপ্রথা অনুসরণ করিত, হিন্দু জগৎ যেন চোখ বুজিয়া কালস্রোতে ভাসিয়া চলিত। আর ইউরোপের জাতিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ভাবিয়া, খাটিয়া, প্রচার করিয়া, অবিরাম উন্নতির পথে অগ্রসর হইতেছিল; এইরূপ এক ক্রমোন্নতিশীল সব জাতিয় সহিত সংঘর্ষ হইবামাত্র বিশাল মারাঠা-সাম্রাজ্য চুর্ণ হইয়া গেল। ইহাই প্রকৃতির বিধান। ইউরোপের সহিত ভারতের এই পার্থক্য আজও রহিয়াছে। ভারত ক্রমশঃ বেশী পিছনে পড়িতেছে, ~রণে বাণিজ্যে, শিল্প, সমবেত চেষ্টায় ইউরোপের তুলনায় দিন দিন অধিকতর ইন ও অসমর্থ হইতেছে। মাবাঠা ইতিহাস হইতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে,
“দিনের দিন সবে দীন
ভারত হয়ে পবাধীন”
আমাদের জাতীয় দুর্দ্দশার সত্য কারণ নহে,— নৈতিক অবনতির ফল মাত্র।
তৃতীয় কারন—সুশাসনের স্থায়ী ব্যবস্থার অভাব
মারাঠা বাজত্বে সময় সময় স্থান- বিশেষে সুশাসন ও প্রজার সুখসম্পদের পরিচয় পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তাহা ব্যক্তিগত এবং অস্থায়ী। কোন বিশেষ রাজা বা মন্ত্রীর গুণে এই সুফল ফলিয়াছিল; আব তিনি চোখ বুজিবা মাত্র আবার আগের সব কি-শাসন ও অরাজকতা ফিরিয়া আসিয়া তাহার কার্য নষ্ট কবিয়া দিত। শিবজির পর শম্ভুজী, মাধব রাও পেশোয়ার পর রঘুনাথ রাও ইহারই দৃষ্টান্ত। এই কারণে মারাঠা – শাসনে দক্ষতার অভাব, ঘুষেব রাজত্ব, এবং হঠাৎ আগাগোড়া পরিবর্তন বড়ই বেশী দেখা যাইত। ইহাতে প্রজার সুখ-সম্পদ নষ্ট হইল, জাতির নৈতিক বল লোপ পাইল।
চতুর্থ কারণ -স্বদেশ অপেক্ষা স্বার্থের টান বেশি
সে যুগের সমাজের অবস্থা এবং লোকের মনে প্রবৃত্তি যেরূপ ছিল তাহাতে জাতি অপেক্ষা নিজবংশ, স্বদেশ অপেক্ষ। পৈত্রিক মৌরসী মহাল (মারাঠী-ভাষায় “বতন”) বেশী মূল্যবান বোধ হইত। দেশে রাজা ও রাজবংশের ঘন ঘন পরিবর্তনের ফলে অনেক স্থলে জমির স্বত্ব বড় অনিশ্চিত এবং গোলমেলে হইয়া উঠিয়াছিল; একই গ্রামের উপর অধিকার দাবি করিত, তিনচার জন ভূস্বামী (যথা, দেশাই, দলবী, সাবত-তাহা ছাড়া দেশের রাজা) এবং পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ করিয়া অথবা বিদেশী আক্রমণকারীর পক্ষে যোগ দিয়া নিজ অধিকার স্থাপিত করিতে চেষ্টা করিত; স্বজাতীয় রাজারা দেশের বিচারালয় এই ব্যক্তিগত স্বার্থের সহায়ক না হইলে তৎক্ষণাৎ তাহাকে অগ্রাহ্য করিয়া দেশের শত্রুকে ডাকিয়া আনিত। ফলতঃ, “বতন” মারাঠা মাত্রেই প্রাণ ছিল, জন্মভূমি কিছুই না। “বতন” রক্ষা বা বৃদ্ধি করিবার জন্য মারাঠারা কোন পাপ করিতেই কুণ্ঠিত হইত না। নিজের জাত, বা শ্রেণীর অপেক্ষা কোন বৃহত্তর একতার বন্ধন সে যুগের হিন্দুরা কল্পনা করিতে পারিত না। নিজের বংশের বা জাতের স্বার্থ অপেক্ষা দেশের হিত যে বড় ও শ্রেয় তাহা রাজা-প্রজা উচ্চনীচ কেহই বুঝিত না, ভাবিত না। সকলেরই চেষ্টা নিজ ধন ও বল, মর্যাদা ও সামাজিক পদ বৃদ্ধি করা, তাহা স্বরাজেই হউক, আর পরাধীনতা স্বীকার করিয়াই হউক।
এই অগণিত শোকসমূহ নিজের স্বার্থ অপেক্ষা কোন মহত্তর উদ্দেশ্য, নিজের ইচ্ছা অপেক্ষা কোন মহত্তর চালনা-শক্তি মানিত না। তাহারা, জীবনের শৃঙ্খলাকে সুখের অন্তরায় এবং নিয়ম-পালনকে দাসত্ব বলিয়া ভাবিত। যদি দেশে সকলেই নিজ নিজ খেয়াল দমন করিয়া এক সর্বব্যাপী বিধি ও সর্বোচ্চ কর্তাকে মানিয়া লয়, তবেই সে জাতি একতাবদ্ধ ও অজেয় শক্তিশালী হইতে পারে, সভ্যতার দ্রুত উন্নতি করিতে পারে। এই জন-সমষ্টির নিয়মানুবর্তিতা (ইংরাজীতে যাহাকে ‘ডিসিপ্লিন’ বা ‘রেন অব ল বলে) যে জাতির নাই তাহারা স্বাধীন হইতে পারে না-স্বেচ্ছাচারীহইয়া, অনাচার অরাজকতা করিয়া শেষে কোনও মহত্তর জাতির নিকট হীনতা-শ্রীকারে বাধ্য হয়, নিজেদের পরাধীনতার শুল নিজেরাই গড়ে। জগতের ইতিহাস যুগে যুগে এই সত্যই প্রচার করিতেছে। অন্যান্য মারাঠা নেতারা এইরূপ উচ্ছৃঙ্খল, স্বার্থে অন্ধ, জাতীয়তার কর্তব্যজ্ঞানহীন ছিল বলিয়াই, শিবাজীর সমস্ত চেষ্টার ফল তাঁহার অবর্তমানে পণ্ড হইল; তিনি যে মহৎ কাজের সূচনা করিয়া যান তাহ স্থায়ী করা, জাতীয় দেহ গড়িয়া তোলা সম্ভব হইল না।