শিবাজী ও আওরংজীব
শিবাজীর কীর্ত্তির আলোকে ভাবতবর্ষের গগণ উদ্ভাসিত হইযাছিল। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে চক্রবর্ত্তী সম্রাটু শাহানশাহ আরংজীব অতুল ঐশ্বর্য্য ও বিপুল সৈন্যবর্ণের অধিকারী হইয়াও বিজাপুর-রাজ্যের জাগীরদারের এই ত্যাজ্যপুত্রকে কিছুতেই দমন করিতে পারিলেন না। মাঝে মাঝে যখন তাঁহার প্রকাশ্য দরবারে দাক্ষিণাত্যেব সংবাদ পড়িয়া শুনান হইত – আজ শিবাজী অমুক জায়গা লুঠ করিয়াছেন, কাল অমুক ফৌজদারকে হারাইয়াছেন, তখন আওরংজীব শুনিয়া নিরুপায় হইয়া চুপ করিয়া থাকিতেন। উদ্বিগ্নচিত্তে মন্ত্রণাগারে গিয়া তিনি বিশ্বস্ত মন্ত্রীদের জিজ্ঞাসা করিতেন, শিবাজীকে দমন কবির জন্য আর কোন্সেনাপতিকে পাঠান যায়, প্রায় সব মহারথীইত দক্ষিণ হইতে পরাস্ত হইয়া ফিরিয়াছেন? এই আলোচনায় এক রাত্রে মহাবৎ খাঁ ব্যঙ্গ করিয়া বলিয়াছিলেন,“হুজুর সেনাপতির দবকারকি? কাজী সাহেবের এক ফতোয়া পাঠাইলেই শিবা ধ্বংস হইবে।” কাজী আবদুল ওহাবের কথায় ধর্মধ্বজী বাদশাহ উঠতেন বসিতেন ইহা সকলেই জানিত।
পারস্যের রাজা দ্বিতীয় শাহ আব্বাস আওরংকীবকে ধিক্কার দিয়াপত্র লিখিলেন (১৬৬৭)—“তুমি নিজকে রাজার রাজা। শাহানশাহ বাদশাহ) বল অব শিবাজীর মত একটা জামিদারক দুরন্ত করিতে পাবিলে না। আমি সৈন্য লইয়া ভারতবর্ষে যাইতেছি তোমাকে রাজ্য-শাসন শিখাইব।” শিবাজীর স্মৃতি কাঁটার মত আওরংজীবে হৃদয়ে আমবণ বিদ্ধ ছিল। মৃত্যুর পূর্বে বাদশাহ পাত্র বা প্রতি যে শেষ উপদেশ লিখিয়া যান, তাহাতে আছে—“দেশের সব খবর রাখাই রাজকার্য্যর সর্বপ্রধান অঙ্গ। এক দণ্ডের অবহেলা বহুবর্ষ ব্যাপী মনস্তাপের কারণ হয়। এই দেখ, অবহেলাব জন্য হতভাগ্য শিবাজী আমার হাত হইতে পলাইল, আর তাহার ফলে আমাকে আমরণ এই পরিশ্রম ও অশান্তি ভোগ করিতে হইল।”
আশ্চর্য্য সফলতা এবং অতুলনীয় খ্যাতিতে মণ্ডিত হইয়া শিবাজী সেই যুগের ভারতে সর্ব্বত্রই হিন্দুদের পক্ষে এক নূন আশার উষা-তার রূপে দেখা দিলেন। একমাত্র তিনি হিন্দুদেব জাত, ও তিলকের, শিখা ও উপবীতের বক্ষক ছিলেন। আশা ভবে সকলেই তাহাব দিকে চাহিয়া থাকিত, তাহার নাম করিয়া সমগ্র জাতি মাথা তুলত।
মারাঠা রাজ্যে পতনের কারন
তবে কেন শিবাজীর রাজনৈতিক অনুষ্ঠান স্থায়ী হইল না? কেন তাঁহার সৃষ্টি তাঁহার মৃত্যুর আট বৎসণের মধ্যেই ভাঙ্গিতে আরম্ভ হইল? কেন মারাঠারা এক রাষ্ট্র সঙ্ঘ (নেশন) হইতে পারিল না? কেন অন্যান্য ভারতীয় রাজন্য ও জাতির মত তাহাবাও বিদেশীর বিরুদ্ধে ডাইতে অসমর্থ হইল?
ইতিহাসের গভীব চর্চা করিয়া ইহার উত্তর পাওয়া যায়।
প্রথম কারণ —জাতিভেদের বিষ
মারাঠা যখন শিবাজীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা-লাভের জন্য খাড়া হয় তখন তারা বিজাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ, তখন তাহারা গরীব ও পরিশ্রমী ছিল, সাদাসিদে ভাবে সংসার চালাইত, তখন তাহাদের সমাজে একতা ছিল, জাত বা শ্রেণীর বিশেষ পার্থক্য বা বিবাদ ছিল না। কিন্তু শিবাজীর অনুগ্রহে রাজত্ব পাইয়া, বিদেশ-লুঠের অর্থে ধনবান হইয়া, তাহাদের মন হইতে সেই অত্যাচার-স্মৃতি এবং তাহাদের সমাজ হইতে সেই সরলতা ও একতা দূর হইল; সাহসের সঙ্গে সঙ্গে অহঙ্কার ও স্বার্থপরতা বাড়িল। ক্রমশঃ সমাজে জাতিভেদের বিবাদ উপস্থিত হইল।
বহুদিন ধরিয়া অনুর্বর দরিদ্র মহারাষ্ট্র দেশের অনেক ব্রাহ্মণই শাস্ত্রচর্চা ও যজন-জন ত্যাগ করিয়া হিন্দু মুসলমান রাজসরকারে চাকরি লইয়া অর্থ ও প্রতিপত্তি ভোগ করিয়া আসিতেছিল। মারাঠা জাত, নিরক্ষর, অসি বা হলজীবী; কিন্তু কায়স্থগণ জাতিতেই “লেখক”, তাহারা লেখাপড়া করিয়া সরকারী চাকরি পাইতে লাগিল, ধনে মানে বাড়িতে লাগিল। ইহা দেখিয়া ব্রাহ্মণেরা হিংসায় জ্বলিতে লাগিল, কায়স্থগণকে শূদ্র ও অত্যজ বলিয়া ঘোষণা করিল। উপবীত গ্রহণের অপরাধে কায়স্থ (প্রভু”) জাতের অকথ্য কুৎসা প্রচার করিল, তাহাদের নেতাদের একঘরে (গ্রামন্য) করিল।
এমন কি শিবাজীর অভিষেকের সময়ই ব্রাহ্মণেরা একজোটে মারাঠা জাতের ক্ষত্রিয় অস্বীকার করিয়া, বৈদিক ক্রিয়া-কর্মে ও মন্ত্রপাঠ শিবাজীর কোন অধিকার নাই এই বলিয়া বসিল। তাহাদের এইরূপ অহঙ্কার ও গোঁড়ামিতে উত্ত্যক্ত হইয়া শিবাজী একবার (১৬৭৪ সালে) বলেন, “ব্রাহ্মণদের জাতিগত ব্যবসা শাস্ত্রচর্চা ও পূজা উপবাস ও দারিদ্র্যই তাহাদের ব্রত; শাসন-বিভাগে চাকরি করা তাহাদের পাপ। অতএব, সব রাহ্মণ মন্ত্রী ও আমলা, সেনাপতি ও দূতকে চাকরি হইতে মাইয়া দিয়া শাস্ত্রগত কাজে লাগাইয়া রাখা হিন্দু রাজার কর্ত্তব্য। আমি তাহাই করিব।” তখন ব্রাহ্মণেরা কাঁদাকাটি করিয়া তাহার ক্ষমা পায়।
এইরূপে ব্রাহ্মণেরা অধিক ক্ষমতা পাইয়া অব্রাহ্মণদিগের প্রতি সামাজিক অত্যাচার অবিচার করিতে লাগিল। আবার ব্রাহ্মণদের মধ্যেও একতা ছিল না। তাহাদের মধ্যে শ্রেণী (বা শাখা)-বিভাগ এবং কৌলীন্য-অভিমান লইয়া ভীষণ দলাদলি ও বিবাদ বাধিয়া গেল। পেশোয়ারা কোঁকনবাসী (“চিৎপাবন” শাখার) ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাহারা যখন দেশের রাজা তখনও পুণা অঞ্চলে স্থানীয় (“দেশ” শাখার) ব্রাহ্মণেরা কোঁঁকনস্থদিগকে অশুদ্ধ হীন-শ্রেণীর ব্রাহ্মণ বলিয়া ঘৃণা করিত, তাহাদের সঙ্গে পঙক্তি-ভোজন করিত না। আবার চিৎপাবনেরা “কহাডে” শাখার ব্রাহ্মণদের উপর খড়গহস্ত। পেশোয়রা অপর অপর শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের গৌরব খর্ব্ব করিবার জন্য রাজশক্তি প্রয়োগ করিতেন। গোয়া-অঞ্চল-বাসী গৌড় সারস্বত (শেবী)-শাখার ব্রাহ্মণেরা অত্যন্ত তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও কার্যদক্ষ, কিন্তু তাহাদিগকে আর সব শ্রেণীর ব্রাহ্মণের প্রায় এখানকার বাঙ্গালী ব্রাহ্মণদের মত অবজ্ঞা ও পীড়ন করিত। এইরূপে জাতের সঙ্গে জাত, এমনকি, একই জাতের মধ্যে এক শাখার সঙ্গে অপর শাখা, বিবাদ করিতে লাগিল; সমাজ ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া গেল, রাষ্ট্রীয় একতা লোপ পাইল, শিবাজীর অনুষ্ঠান ধূলিসাৎ হইল। মারাঠারা রাজ্য হারাইয়াছে, তাহাদের ভারতব্যাপী