শিবাজী শেষ-বয়সে রাজকার্য্যে সর্ব্বদা স্বামীর উপদেশ লইতেন। রামদাসের শিক্ষায় ভক্তিযোগ ও কর্ম্মযোগের অনির্ব্বচনীয় সামঞ্জস্য হইয়াছিল। তাঁহার জীবনের দৃষ্টান্ত এবং জটিল রাজনৈতিক সমস্যায় শিবাজীর প্রতি উপদেশ মহারাষ্ট্র-স্বাধীনতার সাধনাকে সিদ্ধির সহজ পথে আনিয়া দেয়। রামদাসের ধর্ম্মশিক্ষাকে ‘ফলিত ভগবদ্গীতা” বলা যাইতে পারে; তাহার শিষ্য গীতার জীবন্ত দৃষ্টান্ত ছিলেন।
রামদাসে রাজনৈতিক উপদেশ
শিবাজীর পর যুবক শম্ভুজী যখন রাজা হইলেন, তখন বৃদ্ধ রামদাস মৃত্যু আসন্ন বুঝিয়া নূতন রাজাকে অনেক উপদেশ দিয়া পদ্যে এক পত্র লেখেন। তাহাতে আছে—
বহু লোককে একত্র করিবে,
বিচার করিয়া লোক নিযুক্ত করিবে,
শ্রম করিয়া আক্রমণ করিবে
স্নেচ্ছের উপর। ১৪
যাহা আছে তাহার যত্ন করিবে,
পরে আরও [রাজ্য] যোগ করিবে,
মহারাষ্ট্র-রাজ্য [বিস্তার] করিবে
যত্রতত্র। ১৫
লোকদের সাহস দিবে,
বাজি রাখিয়া তরবারি চালাইবে,
‘চড়িয়া বাড়িয়া’ [ক্রমে অধিকতর] খ্যাতি
লাভ করিবে। ১৬
শিব রাজারে স্মরণ রাখিও,
জীবনকে তৃণ সমান মনে করিও,
ইহলােকে পরলােকে তরিবে
কার্ত্তিরূপে। ১৭
শিব রাজার রূপ স্মরণ কর,
শিব রাজার দৃঢ় সাধনা স্মরণ কর,
শিব রাজার কীর্ত্তি স্মরণ কর
ভূমণ্ডলে। ১৮
শিব রাজার বােলচাল কেমন,
শিব রাজার চলন কেমন,
শিব রাজার বন্ধু করিবার ক্ষমতা কেমন,
সেইমত। ১৯
সকল সুখ ত্যাগ করিয়া,
যােগ সাধিয়া,
রাজ্য-সাধনায় কেমন তিনি
দ্রুত অগ্রসর হইয়াছিলেন। ২০
তুমি তাহারও অধিক করিও;
তবে ত তােমাকে পুরুষ বলিয়া জানা যাইবে
* * *। ২১
শিবাজী-পরিবার
শিবাজীর আট বিবাহ—
১। সই বাঈ (নিম্বলকরের কন্যা); মৃত্যু ৫ সেপ্টেম্বর ১৬৬৯ তাঁর পুত্র শম্ভুজী।
২। সয়িরা বাই (শির্কের কন্যা); শিবাজীকে বিষ খাওয়াইয়া মারিয়া ছিলেন এই অপবাদ দিয়া শম্ভুজী তাঁহার প্রাণবধ করেন। তাঁহার পুত্র রাজারাম।
৩। পুতলা বাঈ (মোহিতের কন্যা); স্বামীর চিতায় প্রাণ বিসর্জ্জন করেন।
৪। সাকোয়াব বাঈ (গাইকোয়াড়দেব কন্যা); বিবাহ ১৬৫৬ সালে। ১৬৮৯ সালে মুঘলেরা রায়গড় অধিকার করিবার পর বন্দী। ইঁহাকে অনেক বৎসর আওরংরজাবের শিবিরে থাকিতে হয়।
৫। কাশী বাঈ। মৃত্যু ১৬৭৪ মার্চ্চ মাসে।
৬ ৭। দুইজন স্ত্রী, ১৬৭৪ সালের মে মাসে শিবাজীর অভিষেকের পূর্ব্বে বৈদিক মন্ত্রসহ ইঁহাদের বিবাহ হয়।
৮। একজন স্ত্রী, ৮ই জুন ১৬৭৪ সালে বিবাহ হয়।
শিবাজীব দুই পুত্র ও তিন কন্যা ছিল, যথা।
১। শম্ভুজী, জন্ম ১৪ই মে ১৬৫৭, সিংহাসনলাভ ২৮ জুন ১৬৮০ আওবংজীব কর্ত্তৃক প্রাণবধ ১১ মার্চ্চ ১৬৮৯।
২। রাজারাম, জন্ম ২৪ ফেব্রুয়ারী ১৬৭০, সিংহাসন-অধিরোহণ ৮ই ফেব্রুয়ারী ১৬৮৯, মৃত্যু ২ মার্চ্চ ১৭০০।
৩। সখু বাঈ, মহাফজী নিম্বলকরের স্ত্রী।
৪। অম্বিকা বাঈ, হবজী মহাডিকের স্ত্রী।
৫। রাজকুমারী বাঈ, গণোজীরাজ শির্কের স্ত্রী।
শিবাজীর আকৃতি ও ছবি
শিবাজীর বয়স যখন ৩৭ বৎসর তখন (অর্থাৎ ১৬৬৪ সালে) সুরতের জনকত কইংরাজ তাঁহাকে দেখিয়া এইরূপ বর্ণনা লিখিয়াছেন —“তাঁহার দৈর্ঘ্য মাঝামাঝি রকমের, কিন্তু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি বেশ পরিমাণ-সই। তাঁহার চলন-ফেরন সতেজ জীবন্ত; মুখে মৃদুহাসি লাগিয়াই আছে; চক্ষুদুটি তীক্ষ উজ্জ্বল, সবদিকে ঘুবিতেছে। তাহার বর্ণ সাধারণ দক্ষিণীদের অপেক্ষা গৌর।” ফরাসী-পর্যটক তেভেননা ইহার দুই বৎসর পরে লেখেন,—“এই রাজার আকার হোট, বর্ণ ফরসা, চক্ষুটি প্রচুর তেজঃপূর্ণ এব চঞ্চল।”
শিবাজীব তিনখানি বিশ্বাসযোগ্য ছবি আছে; এগুলি যে তাহার সময়ে আঁকা, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়।
(১) লণ্ডন ব্রিটিশ মিউজিয়মে রক্ষিত প্রতিকৃতি। ইহা একজন ডচ, ভদ্রলোক আওরংজীবের জীবদ্দশায় (অর্থাৎ ১৭০৭ এর পূর্বে) ভারতবর্ষে ক্রয় করেন।
(২) হল্যাণ্ডে রক্ষিত প্রতিকৃতি। ১৭৭২ সালে ডাচ-দূত বাদশাহর নিকট লাহোরে যাইবার সময় ইহা ক্রয় করেন। ১৭২৪ সালে ভ্যালেন্টিন ইহার এক এনগ্রেভিং তাহার পুস্তকে প্রকাশ করেন। এই ছবির একটি অতি সুন্দর (এবং কতক পরিবর্তিত) স্টীল এনগ্রেভিং অর্ম তাহার Historical Fragments গ্রন্থে ১৭৮২ সালে ছাপেন, এবং তাহাই নানাস্থলে পুনর্মুদ্রিত হইয়া ভারতে সর্বত্র পরিচিত হইয়াছে।
(৩) কুমার মুয়জ্জমের চিত্রকর মীর মহম্মদ অশ্বপৃষ্ঠে শিবাজীর যে চিত্র আঁকিয়া ১৬৮৬ সালে মানুশীকে উপহার দেয়, তাহা এখন প্যারিসের রাষ্ট্রীয় পুস্তকাগারে রক্ষিত আছে। ইহার সুন্দর প্রতিলিপি আভিনসম্পাদিত Storia do Mogor গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে আছে, এবং দুখানা খারাপ অনুকরণ (বোধ হয় উড-কাট) ১৮২১ এবং ১৮৪৫ সালে দুইখানি ফরাসী গ্রন্থে মুদ্রিত হয়। কিন্তু দক্ষতার অভাবে এই চিত্রকর শিবাজীর মুখে তাহার চরিত্রের বিশেষত্বটুকু ফুটাইয়া তুলিতে পারে নাই।
বম্বের মিউজিয়মে এবং পুণার ইতিহাস-মণ্ডলের হন্তে শিবাজীর দুইখানাছবি আছে; প্রথমটিতে শিবাজী অসিহস্তে দণ্ডায়মান, দ্বিতীয়টিতে তিনি অশ্বারোহণ তরবারি দিয়া সিংহ-শিকারে নিযুক্ত (মিনিএচার)। এগুলি মুঘল-যুগের হইলেও আঁকিবার কাল ঠিক নির্ণয় করা যায় না।
সব ছবিগুলিতেই শিবাজীর মুখ একই গঠনের, কিন্তু প্রথম দুইখানি ছবিতে তাহার তেজপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ঠিক প্রকাশ পাইয়াছে।
১৪. ইতিহাসে শিবাজীর স্থান
চতুর্দ্দশ অধ্যায় – ইতিহাসে শিবাজীর স্থান