রামদাস স্বামী
শিবাজীর গুরু রামদাস স্বামী (জন্ম ১৬০৮ মৃত্যু ১৬৮১, খৃঃ) মহারাষ্ট, দেশের অতি বিখ্যাত এবং সর্বজনপূজ্য সাধু-পুরুষ। তাঁহার ভক্তিশিক্ষার বাণী অতি সরল সুন্দর ও পবিত্র। ১৬৭৩ সালে সাতারা-দুর্গ জয় করিবার পর শিবাজী গুরুকে উহার চারি মাইল দক্ষিণে পারলী (অথবা সজ্জনগড়া) এ আশ্রম বানাইয়া দেন। এখনও লোকে বলে যে সাতারার ফটকের উপব চূড়ায় একখানা পাথরের ফলকে বসিয়া শিবাজী পাবলী-স্থিত গুরুর সঙ্গে দৈববলে কথাবার্ত্তা কহিতেন। রামদাস আর আর সন্ন্যাসীব মতই প্রত্যহ ভিক্ষা করিতে যাইতেন। শিবাজী ভাবিলেন, “গুরুকে এত ধন ঐশ্বর্য দান কবি, তিনি ভিক্ষা করেন কেন? তাঁহার কিসে সাধ পূরিবে?” তাহার পরদিন একখানা কাগজে রামদাসের নাম সমস্ত মহারাষ্ট্র রাজ্য ও রাজকোষ দিলাম বলিয়া দানপত্র লিখিত তাহাতে নয় মোহর ছাপিয়া ভিক্ষার পথে গুরুকে ধরিয়া তাহার পায়ের উপর রাখিলেন॥ রামদাস মৃদু হাসিয়া বলিলেন,” বেশ তাই এসব গ্রহণ করলাম। আজ হতে তুমি আমার গোমস্তা মাত্র। এই কাজ। . এই রাজ্য নিজের ভোগসুখের বা স্বেচ্ছাচার করিবার দ্রব্য নহে; তোমার মাথার উপণে এক বড় প্রভু আছেন ওঁহর জমিদাব’ তুমি উহার বিশ্বাসী ভৃত্য হইয়া চালাইতেছ—এই দায়িত্বজ্ঞানে ভবিষ্যতে রাজ্যশাসন করিবে।
রাজ্যের প্রকৃত স্বত্বাধিকারী যখন এক সন্ন্যাসী, তখন সেই সন্ন্যাসীর গেরুয়া-বস্তু শিবাজীর রাজপতাকা হইল—ইহার নাম “ভাগবে ঝাণ্ডা।”
“সমর্থ” রামদাস স্বামীর জীবন ও শিক্ষা
১৬০৮ সালে চৈত্র মাসে শুক্ল নবমীতে সূর্য-উপাসক একটি ব্রাহ্মণবংশে রমদাসের জন্ম, তাঁহার পিতার দেওয়া নাম ‘নারায়ণ। বাল্যকাল হইতেই তাহার প্রাণ ধর্ম্মের দিকে আকৃষ্ট হইল; জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মন্ত্রগ্রহণের সময় তিনিও মন্ত্র লইবার জন্য জেদ করিতে লাগিলেন। বারো বৎসর বয়সে এই পিতৃহীন বালক মাতার ব্যাকুল অনুরোধে বিবাহ করিতে সম্মত হইলেন বটে, কিন্তু মন্ত্র পড়িবার সময় বিবাহ-সভা হইতে দৌড়িয়া পলাইয়া গেলেন, এবং সংসার ত্যাগ করিলেন। তাহার পর নাসিক নগরের নিকট গোদাবরী নদীর তীরে পঞ্চবটী দুষ্পাঠ্য বারো বৎস ধরিয়া ধর্ম্মশিক্ষা করিবার পর দুষ্পাঠ্য দীক্ষা লইলেন। মহারাষ্ট্রে লোকে বিশ্বাস দুষ্পাঠ্য তাঁহার আজানুলম্বিত বাহু দুষ্পাঠ্য সাধুগণ বিষ্ণুর অপর অবতার দুষ্পাঠ্য কিন্তু রামদাস দুষ্পাঠ্য কে নিজ ধর্ম্মের উপাস্য দেবতা করেন।
দীক্ষার পর বারো বৎসর ধরিয়া রামদাস দুষ্পাঠ্য প্রবাদ আছে যে স্বপ্নে রামচন্দ্র আবির্ভূত হইয়া তাঁহাকে বলেন দুষ্পাঠ্য ভক্ত সম্প্রদায় গঠন কর।” দুষ্পাঠ্য শেষ করিয়া ৩৬ বৎসর বয়সে (১৬৪৪) রামদাস জন্মভূমিতে ফিরলেন। দুষ্পাঠ্য গ্রামে বসতি করিয়া সেখানে রাম ও হনুমানের দুটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করিলেন (১৬৪৮)। অসাধারণ দক্ষতার সহিত তিনি অল্পদিনেই “রামদাসা” নামে এক নূতন সম্প্রদায় গড়ীয়া তুলিলেন, তাঁহার অনেক শিষ্য হইল, তাহাদের জন্য মঠ স্থাপিত হইল। এই রূপে দশ বৎসর কাটিয়া গেল।
তাহার পর আরও দশ বৎসব ধরিয়া তিনি দুষ্পাঠ্যগড় দুর্গের নিকট শিবতর-গ্রামে নির্জ্জনবাস ও চিন্তার ফলে ‘দাস-বোধ” নামক পদ্য-গ্রন্থ (২০ সর্গে) রচনা করিয়া তাহাতে নিজের ধর্ম্ম-উপদেশ লিপিবদ্ধ করিলেন। সংস্কৃত ও প্রাচীন মারাঠী সাহিত্যে তাঁহার পাণ্ডিত্য ছিল, এজন্য গ্রন্থখানি বড়ই উপাদেয় হইয়াছে।
রামদাসের পুণ্য-প্রভাবে মোহিত হইয়া শিবাজী ‘শ্রীরাম, জয় রাম, জয় জয় রাম” এই মন্ত্রে তাহার নিকট দীক্ষা লইলেন। গুরু তাঁহাকে সংক্ষেপে অতি মহান্ উপদেশ দিলেন। কিন্তু যখন শিবাজী ভক্তির আবেগে বলিলেন, “আমি আপনার চরণে থাকিয়া সেবা করিব” তখন রামদাস তাহাকে ধমকাইয়া নিষেধ করিলেন, বলিলেন, “ইহার জন্যই কি তুমি আমার কাছে প্রার্থী হইয়া আসিয়াছ? তুমি ক্ষত্রিয়, কর্ম্মবীর, তোমার কর্তব্য দেশ ও প্রজাদের বিপদ হইতে রক্ষা করা, দেবব্রাহ্মণের সেবা করা। তোমার করিবার অনেক কাজ রহিয়াছে। ম্লেচ্ছগণ দেশ ছাইয়া ফেলিয়াছে; তোমার কর্তব্য তাহাদের হাত হইতে দেশ উদ্ধার করা। ইহাই রামচন্দ্রের অভিপ্রায়। ভগবদ-গীতায় অর্জুনের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ স্মরণ কর—যোদ্ধার কর্তব্যের পথে চল, কর্ম্মযোগ সাধনা কর।”
১৬৭৩ সালে পারলি-দুর্গ অধিকার করিবার পর শিবাজী সেখানে রামদাস স্বামীকে আনিয়া বসাইলেন, তাহার জন্য মন্দির ও মঠ নির্মাণ করিয়া দিলেন, দুর্গের নূতন নাম রাখিলেন সজ্জনগড়, অর্থাৎ “সাধুর গড়”; সন্ন্যাসী ও ভক্তদের ভরণ-পোষণের জন্য নিকটের গ্রামে দেবোত্তর জমি দিলেন।
কর্ম্মযোগের আদর্শ রামদাস শিবাজীকে শ্রেষ্ঠ কর্মযোগী বলিয়া সর্বদাই প্রশংসা করিতেন, তাঁহাকে সকলের সম্মুখে রাজার আদর্শ বলিয়া গরিতেন। রামদাস কর্তৃক পদে রচিত শিবাজীর নামে এক পত্র মহারাষ্ট্র দেশে প্রচলিত আছে, তাহাতে গুরু রাজাকে সম্বোধন করিতেছেন-“হে নিশ্চয়ের মহামেরু! বহুলোকের সহায়, অটলপ্রতিজ্ঞ, ইন্দ্রিয়জয়ী, দানবীর, অতুল গুণসম্পন্ন, নরপতি, অশ্বপতি, গজপতি, সমুদ্র ও ক্ষিতির অধীশ্বর, সদা প্রবল বিজয়ী, বিখ্যাত ধার্মিক বীর! •••পৃথিবী তোলপাড় হইয়াছে; ধর্ম্ম লোপ পাইয়াছে। গো-ব্রাহ্মণ, দেব ধর্ম রক্ষা করিবার জন্য নারায়ণ তোমাকে পাঠাইয়াছেন। .. ধর্ম্মসংস্থাপনের জন্য নিজ কীর্ত্তি অমর রাখিও।”