শিবাজীর সৈন্য-সংখ্যাইংরাজ-যুগের পূর্ব্বেই আমাদের দেশে দুই রকম অশ্বারোহী সৈন্য ভর্তি করা হইত; যাহারা সম্পূর্ণভাবে রাজার চাকর এবং রাজসরকার হইতে অস্ত্র বর্মও অশ্ব পাইত তাহাদের নাম “পাগ”;আর যে-সব ভাড়াটে অশ্বারোহী নিজেই অস্ত্র বর্ম ও ঘোডা কিনিয়া, ডাক পড়িলে নানা রাজ্যে বেতনের লোভে কাজ করিত, তাহারা “সিলদার”। পাগা সৈন্যদের ফারসী ভাষায় “বার-গৗর” (= ভারবাহ) বলা হইত, ইহা হইতে আমাদের “বরগী” শব্দের উৎপত্তি। যে বৎসর বা যে অভিযানে যত লোক আবশ্যক, হইত, সেই অনুসারে রাজা কম বেশী সিলদার ভাড়া করিতেন।
রাজ্যস্থাপনের গোড়ার দিকে শিবাজীর অধীনে এক হাজার (অথবা বারে শত) পাগা এবং দুই হাজাব সিলদার অশ্বারোহী ছিল। তাহার পর রাজ্যবিস্তার ও দূর দূর দেশ আক্রমণের ফলে তাঁহার সৈন্যদল ক্রমশঃ বাড়িয়া জীবনের শেষ বৎসরে দাঁড়াইয়াছিল—৪৫ হাজার পাগ। (১৯ জন সেনানীর অধীনে ২৯ দলে বিভক্ত) এবং ৬০ হাজার সিলাদার (৩১ জন সেনানীর অধীনে); আর এক লক্ষ মালে পদাতিক (৩৬ জন সেনানীর অধীনে)। এই পদাতিকগুলি বর্তমান সভ্যজগতের সৈন্যদের মত বারো মাস কুচকাওয়াজ করিত না বা রাজার কাজে সৈন্য-আবাসে আবদ্ধ থাকিত; তাহারা চাষের সময় নিজ গ্রামে গিয়া জমি চাষ করিত, আর বিজয়া দশমীর দিন বিদেশ আক্রমণ করিবার জন্য, অথবা যুদ্ধের আশঙ্কা থাকিলে তাহার আগেই, আবার সৈন্য-নিবাসে আসিয়া জুটিত; তখন তাহাদের অস্ত্র বর্ম্মে সজ্জিত ও ও দলবদ্ধ করিয়া নেতার অধীনে রাখিয়া সৈন্যদল গঠন করা হইত। দুর্গরক্ষী পদাতিকের ইহাদের হইতে পৃথক; তাহারা দুর্গের নীচে চাষ করিবার জন্য জমি পাইত, এবং পরিবারদিগকে দুর্গে (কখন-বা ঐ নীচে গ্রামে) রাখিত। ইহারা বারোমেসে চাকর; ঘর ছাডিয়া দূরে যাইতে হইত না।
শিবাজীর নিজের ১২৬০ (অন্য মতে তিন শত) হাতা, তিন হাজার উট, এবং ৩৭ হাজার ঘোড় ছিল।
সৈন্য-বিভাগেব শৃঙ্খলারাজার নিজ অশ্বারোহী (আর্থাৎ পাগ)-র দল এইরূপে গঠিত হইত। ২৫ জন সাধারণ সৈন্যের (বারগার-এর) উপর এক হাবলদার (যেমন সার্জেন্ট), পাঁচ হাবলাদার (অর্থাৎ ১২৫ জন সাধারণ সওয়ার)এর উপর এক জুমলদার (যেমন কাপ্টেন), এবং দশ জুমলাদার (অর্থাৎ, ১২৫০ জন সওয়ার)-এর উপর এক হাজারী (অর্থাৎ কর্ণেল)। তাহার উপর পাঁচ হাজারী (ব্রিগেডিয়ার জেনারাল, এবং সর্বোচ্চ সরু-ইনৌবৎ (কমাণ্ডার-ইন-চীফ)। প্রতি ২৫ জন অশ্বারোহীর জন্য একজন ভিস্তি ও একজন নালবন নির্দিষ্ট ছিল।
পদাতিক বিভাগে নয়জন সিপাহী বা পাইক’-এর উপর এক নায়ক (কপোল), পাঁচ নায়কের (অর্থাৎ ৪৫ পাইকের) উপর এক হাবলাদার, দুই বা তিন) হাবলদারের উপর এক জুম্লাদার, দশ জুমদার (অর্থাৎ ৯০০-১৩৫০ পাইক)-এর উপর এক হাজারী।
রাজার শরীর-রক্ষী (গার্ড ব্রিগেড) ছিল দুই হাজার বাছা বাছা মাবুলে পদাতিক, খুব জমকাল পোষাক ও ভাল ভাল অস্ত্রে সজ্জিত। প্রত্যেক সৈন্যদল (রেজিমেন্ট)-এর সঙ্গে হিসাবপরীক্ষক (মজমুয়াদার), সরকার (কারভারি), আয়-লেখক (জমা-নবিস) এক একজন করিয়া থাকিত।
পাগা জুম্লাদারের ” মজমুয়াদারের ” হাজারীর ” জমানবিস প্রভৃতি তিনজনের একুন ” পাঁচ-হাজারীর পদাতিক জুমলাদারের ” ” সবনবিসের ” হাজারীর ” ” সবনবিসের |
বার্ষিক বেতন ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” |
৫০০ হোণ ১০০ হইতে ১২৫” ১,০০০ ” ৫০০ ” ২,০০০ ” ১০০ হোণ ৪০” ৫০০” ১০০ হইতে ১২৫” |
শিবাজীর রণনীতি
তাঁহার সৈন্যগণ বর্ষাকালে নিজ দেশে ছাউনিতে যাইত; সেখানে শস্য, ঘোড়ার আস্তাবলের ব্যবস্থা থাকিত। বিজয়া দশমীর দিন সৈন্যগণ ছাউনি হইতে কুচ করিয়া বাহির হইত, আর সেই সময় সৈন্যদলের ছোটবড় সব লোকের সম্পত্তির তালিকা লিখিয়া রাখা হইত, তাহার পর দেশ লুঠিতে যাইত। আট মাস ধরিয়া লস্কর পরের মুলুকে পেট ভরাইত, চৌথ আদায় করিত। স্ত্রী, দাসী, নাচের বাঈজী সৈন্যদলের সঙ্গে যাইতে পারিত না। যে সিপাহী এই নিয়ম ভঙ্গ করিত তাহার মাথা কাটার হুকুম ছিল। “শত্রুর দেশে স্ত্রীলোক বা শিশুকে ধরিবে না, শুধু পুরুষ মানুষ পাইলে বন্দী করিবে। গরু ধরিবে না, ভার বহিবার জন্য বলদ লইতে পার। ব্রাহ্মণদের উপর উপদ্রব করিবে না, চৌথ দিবার জামিন-স্বরূপ কোনও ব্রাহ্মণকে লইবে না। কেহ কু-কর্ম্ম করিবে না। আট মাস বিদেশে সওয়ারী করিবার পর বৈশাখ মাসে ছাউনিতে ফিরিয়া আসিবে। তখন, নিজ দেশের সীমানায় পৌঁছিলে সমস্ত সৈন্যের জিনিষপত্র খুঁজিযা দেখা হইবে, পূর্বের তালিকার সঙ্গে মিলাইয়া যাহা অতিরিক্ত পাওয়া যায় তাহাব দাম উহাদেব প্রাপ্য বেতন হইতে বাদ দেওয়া যাইবে। বহুমূল্য জিনিষ থাকিলে তাহা বাজসরকারে জমা দিতে হইবে। যদি কোন সিপাহী ধনরত্ন লুকাইয়া রাখে এবং তাহার সর্দার টের পায়, তবে তাহাকে শাসন কবিতে হইবে।
“সৈন্যদল ছাউনিতে পৌঁছিলে, হিসাব করিয়া লুঠের (সোনা, রূপা) বড় ও বস্ত্রাদি সঙ্গে লইয়া সব সর্দাবে বাজাব দশনার্থ যাইবে। সেখানে হিসাব বুঝাইয়া দিয়া, মালপত্র রাজভাণ্ডারে রাখিয়া, সৈন্যদেব বেতনের হিসাব যাহা প্রাপ্য তাহা রাজকোষ হইতে হইবে। যদি নগদ টাকার বদলে কোন দ্রব্য লইতে ইচ্ছা হয় তাহা হুজুরের কাছে চাহিয়া লইবে। গত অভিযানে যে যেমন কাজ ও কষ্ট সহ্য কবিয়াছে তদনুসারে তাহার পুরস্কার হইবে। কেহ নিয়মবিদ্ধ কাজ করিয়া থাকিলে, তাহার প্রকাশ্য অনুসন্ধান ও বিচার করিয়া তাহাকে দুর করিয়া দেওয়া হইবে। তাহার পর চারি মাস (অর্থাৎ আবার দশহরা পর্যন্ত) ছাউনিতে থাকিবে।” [সভাসদ-বখর]